তখনো ভোরের আজান হয়নি। রাত-রাত ভাবটা রয়েই গেছে। বাড়ির পেছনে সরকারবাড়ির বাঁশঝাড়ে অসংখ্য পাখির কিচিরমিচির। শালিক, ময়না, দোয়েল, চড়ুই পাখিই বেশি। কাকের কা-কা শব্দও আছে। এইসব পাখির ডাকাডাকিতেই বোঝা যায় – ভোর হয়ে এলো বলে। ময়নার মা আরো আগে ঘুম থেকে উঠেছে। এমনিতেই তার পাতলা ঘুম। ক্ষুধা পেটে ঘুম তো আসতেও চায় না। জোর করে চোখ বুজে মড়ার মতো পড়ে থাকাই সার! প্রাতকৃত্য সেরে হাতমুখ ধুয়ে সে বাইরে বেরোনোর জন্য তৈরি হচ্ছে। দুদিন ভোটঘরে গিয়ে খালি হাতে ফিরে এসেছে। তার নাম ডাকার আগেই, লাইনে তার সামনে আরো দশ-বারোজন ছিল – চাল, ডাল, আলু-পেঁয়াজ, সয়াবিন তেল – যা ছিল সব শেষ। টিসিবির ট্রাক খালি, শুধু ময়নার মা কেন – আরো শতেক মহিলাকে ফিরতে হয়েছে খালি হাতে। পুরুষ-মানুষও কেউ-কেউ খালি হাতে ফিরেছে। আজ আবার টিসিবির ট্রাক আসবে ভোটঘরে। সপ্তাহে একদিন আসে। আগেভাগে গিয়ে, আজ যে-করেই হোক লাইনের সামনের দিকে দাঁড়াতে হবে। কোত্থেকে যে এত মানুষ আসে! কয়শো কার্ড দিয়েছে ইউনিয়নে? গরিব মানুষই বা কত? টিসিবির কার্ড পেতে আলিম মেম্বারকে, যে কি না আবার সরকারিদলের নেতাও, তাকে পাঁচশো টাকা দিতে হয়েছে।
মাস কাবার হয়ে এলো, ময়নার মা একদিনও চাল-ডাল পেল না। সবাই তাকে কনুই মেরে পেছনে ফেলে লাইনের সামনে চলে
যায় …।
ময়নার বাপ জাগনা পাইছ …?
ঘুমাইলে তো জাগনা পামু …?
পেটে ক্ষুধা থাকলে কারই বা ঘুম আসে। ময়নার মায়ের যেমন ঘুম আসে না, সারারাত এপাশ-ওপাশ করে; ময়নার বাবার চোখেও ঘুম আসে না। সেও সারারাত এপাশ-ওপাশ করে। চোখে কখনো হয়তো একটু তন্দ্রার মতো আসে, চোখের পাতা একটু ভারী হয়, আর তখনই আবছা-আবছা স্বপ্ন দেখে – ভাতের স্বপ্ন। ময়নার মা, ছোট দুই মেয়ে শেফালি আর বকুলকে নিয়ে গোল হয়ে বসে। গামলায় ভাপ ওঠা গরম ভাত, পুঁটি মাছ ভাজা, কচু ভর্তা, পিয়ালি মাছের তরকারি; সবাই মিলে পেটপুরে ভাত খায়। ময়নার বাবা রহমত আলি খাওয়া শেষে আয়েশ করে ঢেঁকুর তোলে। ছেলেটা, রতন, সবার ছোট, বয়স দেড় বছরের মতো, ভাত খাওয়া শেখেনি, তবুও সে সবার সঙ্গে বসে, গরম ভাতের গামলায় হাত দিতে যায়, ময়নার মা হায় হায় করে ওঠে; রহমত খাওয়া শেষ করে বারান্দায় বসে হুঁকো টানে। একটা সময় ছিল,
গাঁয়ে-ঘরে সবার বাড়িতেই হুঁকো ছিল, আইলায় আগুন থাকতো, তামাকের ডিব্বা থাকতো, অতিথি কি প্রতিবেশী কেউ এলে হুঁকো সাজিয়ে দিতো, এখন প্রায় কোনো বাড়িতেই হুঁকো নেই, বিড়ি-সিগারেটের চল এসেছে। বিড়িও কম, সবার পকেটেই, যারা ধূমপানে অভ্যস্ত, তাদের পকেটে সিগারেটের প্যাকেট থাকে। কিন্তু রহমত আলীর বাড়িতে এখনো হুঁকো, আইলা, তামাকের ব্যবস্থা আছে। রহমত স্বপ্নের ভেতরেই ভাত খাওয়া শেষে হুঁকো সাজিয়ে বসে …।
এই যে তন্দ্রার মধ্যে ভাপ ওঠা ভাতের স্বপ্ন দেখা, রহমত আলীর এটা একটা রোগের মতো হয়ে গেছে, প্রত্যেক রাতেই সে এই স্বপ্ন দেখে এবং তন্দ্রা কেটে যাওয়ার পর স্বপ্ন অপসৃত হয়ে গেলে রহমতের শরীরে কাঁপন শুরু হয়ে যায়। সে আলগোছে, ময়নার মা কিংবা ছেলেমেয়েরা যাতে টের না পায়, সে উঠে বসে। ঘরের বাইরে যায়। রহমতের বাড়ির পেছনে সরকারবাড়ির বাঁশঝাড়, কিন্তু সামনে খোলা। খোলা চক। প্রচুর বাতাস চকে। রহমতের গা জুড়িয়ে যায়। অনেকক্ষণ কামরাঙা গাছের নিচে পাতা মাচালের ওপর বসে থাকে। আস্তে-আস্তে স্বপ্নের ঘোর কেটে যায়। আবার চুপচাপ ঘরে গিয়ে শুয়ে পড়ে …।
ভাপ-ওঠা ভাতের স্বপ্ন প্রায় প্রতিরাতেই ময়নার মাও দেখে। কিন্তু সে তা স্বামী কি অন্য কারো কাছে যেমন প্রকাশ করে না, রহমত আলীও স্বপ্নের কথা স্ত্রী কি কারো কাছে প্রকাশ করে না। এটা যেন কোনো গোপন রোগ। প্রকাশ পেলে সর্বনাশ! কোথাও মুখ দেখানো যাবে না …।
পাঁচ-সাত বছর আগেও, যে-বছর বড় মেয়ে ময়নার বিয়ে দিলো – পরিস্থিতি এরকম ছিল না। বিয়ের দিন মোটামুটি ধুমধাম করেছিল বাড়িতে। দিনমজুরির টাকা জমিয়েই তো বিয়ে দিলো মেয়ের। আর এখন মেয়েদের খেতেই দিতে পারে না। ছোট ছেলের জন্য একটু দুধ কেনা তো দুঃস্বপ্নের মতো। শেফালিটার খাওয়ার প্রতি একটু ঝোঁক বেশি। পেট পুরে খেতে না পেয়ে মেয়েটা কেমন পাটকাঠির মতো শুকিয়ে যাচ্ছে। তখন চাল ছিল ৩০ টাকা কেজি, মসুর ডাল ৭০ টাকা। আর এখন! কোনো জিনিসে হাত দেওয়া যায় না। চালের কেজি ৬০ টাকা, ডালের কেজি ২০০ টাকা। পেঁয়াজ-মরিচ, যা দুদিন ঘরে থাকলেই পচে যায়, তারও দাম কত? দুশো-আড়াইশো টাকা কেজিতেও মেলে না। এক কেজি শিমের দাম ১৫০ টাকা, ঢেঁড়শের কেজি ১০০ টাকা, একটা চালকুমড়োর দাম ১৫০ টাকা;
চাল-ডাল, তরিতরকারি, শাক-সবজির দাম ছয় মাসের মধ্যেই দ্বিগুণ হয়ে গেল; একহালি ডিমের দাম ৬০ টাকা; রোগীর পথ্য ডাব, পোয়াখানেক পানি ভেতরে থাকলেই তার দাম ১৪০ কি, ১৫০ টাকা। মানুষ কী খেয়ে বাঁচে …?
সব জিনিসের দাম বেড়েছে, তা ঠিক। তারপরও বেঁচে থাকার একটা উপায় হতো কিন্তু তার কোমরের ব্যথাটাই তাকে মেরে ফেললো। ঠিকমতো কাজ করতে পারলে, মজুর খাটলে কি রিকশা চালাতে পারলে প্রতিদিন, এতটা দুর্গতি নামতে পারতো না তার সংসারে। টাকার অভাবে চিকিৎসা হচ্ছে না, গোটাকয়েক ব্যথার বড়ি যে কিনে খাবে রহমত আলীর সেই সামর্থ্যও নেই। চিকিৎসা ছাড়া কি রোগ ভালো হবে …?
রহমত আলীকে যে কোমরের ব্যথায় ধরেছে, আক্রমণটাও খুবই মারাত্মক, ব্যথা যখন ওঠে, তখন শুয়ে-বসে কি দাঁড়িয়ে, কোনোভাবেই ব্যথা কমে না, যেন সহ্যের অতীত; পাঁচ বছর অন্তত হবে এই ব্যথার উপদ্রব শুরু হয়েছে, রিকশা অ্যাক্সিডেন্টের পর থেকেই। রহমত আলী শহরে রিকশা চালাতো, সে শুধু একা না, গাঁয়ের তার বয়সী হুরমুজ, কুদরত, জাবেদ, নূর মোহাম্মদ – আরো অনেকেই রিকশা চালাতো শহরে। দুপুরের পরপর শহরে যেত, আলিমুদ্দি সিকদারের গ্যারেজের রিকশা, রাত ১০টা-১১টা পর্যন্ত রিকশা চালিয়ে রাতে সবাই একসঙ্গে বাড়ি ফিরত। আয়-রোজগার নেহায়েত মন্দ হতো না, নিজের খাই-খরচা, মালিকের ভাড়া মিটিয়ে একদিনে যা থাকত, তাতে সংসারের দুদিনের খরচ অনায়াসে উঠে যেত, অর্থাৎ সঞ্চয় থাকত ভালোই। রহমত আলি, হুরমুজ, কুদরত – তিনজনেই রিকশা চালানোর সঞ্চয় দিয়ে যার যার মেয়ের বিয়ে দিয়েছে। জাবেদ আর নূর মোহাম্মদের বিয়ের যুগ্যি মেয়ে নেই, ওরা দুজনে সঞ্চয়ের টাকা দিয়ে রেহানে জমি রেখেছে, তাতে প্রায় ছয় মাসের খোরাকি ধান উঠে আসে। বলতে হয় – ওদের সংসারে তেমন অভাব ছিল না কখনোই, রহমত বাদে অন্য সবার এখনো, চাল-ডাল, তেল-আলু, পেঁয়াজ-মরিচ, দুধ-দই, মাছ-মাংস, কাপড়-চোপড়, ওষুধপথ্য – সবকিছুর দাম বেড়েছে, কোনোটার দাম দ্বিগুণ, কোনোটার দাম তিন-চারগুণ হয়েছে, তবু কষ্ট করে হলেও তাদের দিন চলে যায়। কেউই রহমত আলীর মতো অথই সাগরে পড়েনি। সেও সাগরে হাবুডুবু খেত না – এভাবে অ্যাক্সিডেন্টে পড়ে কোমরটা অকেজো হয়ে না গেলে …।
সেদিন সন্ধ্যায়, বলতে গেলে তখনো সন্ধ্যা তেমন করে নামেনি, রহমত আলি কেবলই রিকশায় হারিকেন জ্বালিয়েছে, মাগরিবের আজান হয়েছে একটু আগে, রহমতের রিকশায় তখন যাত্রী নেই, কালীবাড়ি মোড় থেকে খালি রিকশা নিয়ে পুরনো বাসস্ট্যান্ডে মার্কেট ঘেঁষে রিকশা থামিয়ে, রিকশার সিটে বসে বিড়ি ধরিয়ে টানছিল; স্ট্যান্ডে তেমন রিকশা নেই, যানজটও নেই, আইল্যান্ডে দাঁড়িয়ে ট্রাফিক পুলিশ ডিউটি করছে, এরই মধ্যে দৈত্যের মতো একটি বাস আসছিল ঢাকা থেকে, ট্রাফিক মোড় ঘোরার সময় বাসটি সজোরে ধাক্কা মারে রহমতের রিকশার পেছনে। রহমতের রিকশাটি গুঁড়িয়ে যায়, সে ছিটকে পড়ে রাস্তার ওপর। তার মা বোধহয় লাউয়ের পাতা বিলিয়েছিল তাই সে বেঁচে যায়; কিন্তু সোজা হয়ে দাঁড়াতে পারে না। কোমরে প্রচণ্ড ব্যথা …।
ওরা পাঁচজনেই একই গ্যারেজের রিকশা চালায়। রাতে একসঙ্গে বাড়ি ফেরে। রাতে যে যখনই রিকশা গ্যারেজে জমা দিক না কেন, সাড়ে দশটা-পৌনে এগারোটার মধ্যেই নতুন বাসস্ট্যান্ডে একত্রিত হয়। তারপর যমুনা সেতুর বাসে উঠে বাড়ি। রাত ১১টায় সেতুর শেষ গাড়ি ছাড়ে। কিন্তু সেদিন সাড়ে দশটা, পৌনে এগারোটা, এগারোটা বেজে গেল, সেতুর শেষ গাড়ি বারবার হুইসেল বাজাচ্ছে, সে এখনই ছেড়ে দেবে, এই বাস ধরতে না পারলে সিএনজিচালিত অটোতে বাড়ি যেতে হবে, ভাড়া তিনগুণ, কিন্তু রহমত আলির খবর নেই। সে আজ এত দেরি করছে কেন? খেপ নিয়ে কতদূর গেছে? কোনো বিপদ-আপদ হয়নি তো? চারদিকে যেভাবে রিকশা-অটোরিকশা ছিনতাই হচ্ছে! যাত্রীবেশী ছিনতাইকারীরা খুবই ভয়ংকর। নিবিই যখন, রিকশা নিয়ে চলে যা। কিন্তু ওরা তা করে না। গলা কেটে চালককে খুন করে, সাক্ষী রাখে না; যেন তাদের কেউ খুঁজে বের করতে না পারে …।
রাত সাড়ে এগারোটা বেজে গেল। কুদরত জাবেদকে উদ্দেশ করে বললো – একবার ফোন করে দ্যাখ দেখি …। তাই তো! আরো আগেই ফোন দেওয়া উচিত ছিল। বললো জাবেদ। তারপর জাবেদ কোমরে গুঁজে রাখা ফোন বের করে রহমতের নম্বরে ফোন করলো। ফোন বন্ধ। ‘দুঃখিত, আপনি যে নম্বরে কল করেছেন তা এখন বন্ধ রয়েছে। অনুগ্রহপূর্বক কিছুক্ষণ পর আবার ডায়াল করুন।’ জাবেদ বললো – ফোন তো বন্ধ। রিং ঢুকে না …!
তাইলে …?
নও গেরেজে যাই। দেহি, আলিমুদ্দি বাই কিছু জানে কি না …?
ওরা চারজন আলিমুদ্দি সিকদারের গ্যারেজের দিকে হাঁটা শুরু করলো। পাঞ্জাপাড়া গ্যারেজ …।
আলিমুদ্দিও গ্যারেজে অপেক্ষা করছিল, সবাই রিকশা জমা দিয়ে গেছে, রাত বারোটা বেজে এলো, রহমত এখনো কেন আসছে না; সে এলেই গ্যারেজে তালা দিতে পারে। রহমতের জন্য অপেক্ষা করতে-করতে আলিমুদ্দির দারুর বোতল শেষ হয়ে গেছে। আর অপেক্ষা করা যায় না …।
সন্ধ্যার পর থেকেই, রাত কিছুটা ঘনিয়ে এলে, এই ধরুন আটটা কি সাড়ে আটটা বাজে; আলিমুদ্দি নিজের গদিতে বসেই দারুর বোতল খোলে। দীর্ঘ বিরতি দিয়ে এক ঢোক, এক ঢোক করে দারু গলায় ঢালে আলিমুদ্দি। তার গ্যারেজে একশর ওপরে রিকশা। সুতরাং সহজ হিসাব, দুবেলায় দুশোর বেশি তার রিকশাচালক, সবাই জানে তাদের মালিক আলিমুদ্দি সন্ধ্যা নামার পর থেকেই দারু খায়, কিন্তু কোনোদিনই কেউ তাকে মাতাল হতে দেখেনি, সব রিকশার ভাড়া ঠিকঠাকমতো নিয়ে, খাতায় টাকা জমা করে, কেউ টাকা বাকি রাখলে সেটিও খাতায় তোলে, গ্যারেজে দামি চারটা তালা মেরে বাসায় যায়, সাড়ে এগারো কি বরোটার দিকে। কোনোদিন টাকা-পয়সার হিসাবে কোনো ব্যতিক্রম ঘটে না; সেদিনও সবার হিসাব ঠিকঠাকমতো খাতায় লিখে বসে আছে, দারুর বোতল খালি, কিছুই করার নেই, রাগে ফুঁসছে; তখনই কুদরত আলীরা চারজন গ্যারেজে ঢুকলো। ওদের দেখেই, আলিমুদ্দি যা কোনোদিন করে না, কোনো রিকশাওয়ালা যা কোনোদিন দেখেনি, হুরমুজ, কুদরত, জাবেদ, নূর মোহাম্মদ কি অন্য কেউ; আলিমুদ্দি সেদিন তাই করলো; খিস্তিখেউর শুরু করে দিলো; ওই কুত্তার বাচ্চারা, হারামির বাচ্চারা, তগোরো লিগা আমি সারা রাইত গ্যারেজে বইয়া থাকমু? রহমত কই? আমার ১০৩ নম্বর রিকশা কই …?
আলিমুদ্দি সেদিন মাতাল হয়েছিল তা ঠিক, কিন্তু রহমত আলি তার গ্যারেজের যে রিকশাটি চালায়, নম্বর ১০৩, রিকশার সেই নম্বর তার ঠিকই মনে আছে …।
আলিমুদ্দির মেজাজ দেখে ওরা ভয় পেয়ে গেল। ভীতসন্ত্রস্ত হয়ে উঠলো। মালিকের আজ কী হয়েছে। মেজাজ এত গোলমরিচের মতো চড়া কেন …?
কুদরত আলি ভয়ে ভয়ে মিনমিন করে বললো – রহমত ভাইর তালাশেই তো আইলাম। আমরা সেই সাড়ে ১০টা
থিকা বাসস্ট্যান্ডে বইয়া আছিলাম। তার খোঁজ নাই। ভাবলাম, আপনে যদি কিছু জানেন …?
থানায় গেছিলি …?
না। থানায় যামু ক্যা …!
হাসপাতালে …?
না। আমরা তার অপেক্ষায়, প্রত্যেক দিন যেরকম, আমাগোর কেউ আইতে দেরি করলে আমরা যেমন তার জন্য দেরি করি, আইজো, সেরকম, রহমত ভাইর জন্য দেরি করতাছিলাম …।
রহমত আলি দশদিন পর হাসপাতাল থেকে ছুটি পায়। ছুটি তো পেল, হাতে-পায়ে কাটাছেঁড়া যা হয়েছিল, ঘা শুকিয়ে গেছে, কিন্তু বাসের ধাক্কায় নিজের রিকশার সিট থেকে ছিটকে পড়ে কোমরে যে-ব্যথা পেয়েছিল, এতদিনেও সেই ব্যথা আর ঠিক হলো না। রিকশা চালানো তো দূরস্থান, ভারী কোনো কাজই রহমত আলি করতে পারে না। বলা যায়, একরকম পঙ্গুই সে হয়েছে। সংসার চালায় ময়নার মা। কিন্তু কীভাবে চালায়, তা আর বলার মতো না। রহমত আলি যে-বছর পঙ্গু হলো, চালের কেজি ছিল ৩০ টাকা, ডালের কেজি ৭০ টাকা, তা
বাড়তে-বাড়তে, দ্যাখো, এখন কত হয়েছে। চাল ৬০ টাকা কেজি, ডাল ১৪০ টাকা কেজি; হাঁস-মুরগির ডিম বেঁচে, বিল থেকে শাপলা-শালুক তুলে বিক্রি করে সংসার চালানো কী যে কঠিন, তা যে চালায় সে-ই জানে। এই
অভাব-আকালের দিনে শিউলি-বকুলের একজনকে রিকশার মালিক আলিমুদ্দি নিতে চেয়েছিল, তাকে দিয়ে দিলেই বোধকরি ভালো ছিল। খাওয়ার একটা মুখ তো কমতো। শিউলি-বকুল যমজ বোন, বাড়ন্ত শরীর, দুই বোনের খোরাকও বেশি। কিন্তু এখন?
আধবেলা-একবেলা খেতে-খেতে চিমসে ধরে গেছে ওদের শরীর। কেমন চেনাই যায় না …।
রহমত আলি দশদিন হাসপাতালে ছিল। ময়নার মা মাঝখানে দুদিন স্বামীকে দেখতে গেছে। যেদিন ছুটি দিলো, সেদিন তো গেছেই। তিনদিনই হাসপাতালে আলিমুদ্দি সিকদারের সঙ্গে দেখা হয়েছে। হাসপাতালে গেলেই ময়নার মা দেখতো – আলিমুদ্দি তার স্বামীর মাথার কাছে চুপচাপ বসে আছে। দ্বিতীয় দিন আলিমুদ্দি ময়নার মাকে বললো – রহমতের বউ, লও বাইরে যাই, তোমার লগে দুইডা জরুরি কথা আছে …।
হাসপাতালের সামনে দুটো ঝাঁকড়া বকুলগাছ। গোড়া শান-বাঁধানো। রোগী দেখতে এসে রোগীর আত্মীয়স্বজনরা অনেকেই এখানে বসে। সেদিন দুপুরবেলা, ছোট গাছটির গোড়ায় লোকজন নেই। আলিমুদ্দি ময়নার মাকে নিয়ে সেখানে বসলো। ময়নার মা ভেবে পাচ্ছে না রিকশার মালিক, রিকশাটি তো গেছেই, ময়নার বাবার চিকিৎসার খরচাপাতিও দিচ্ছে এই লোকটিই; এখানে কেন নিয়ে এলো, কী কথা আছে তার, কে জানে! শহরের মানুষ, ভেতরে-ভেতরে কাঁপছে ময়নার মা …।
রহমতের বউ …।
জে …।
তোমার জানি কয়ডা বাচ্চা …?
তিন ম্যায়া, এক পোলা। পোলা এই যে, দুধের বাচ্চা। বড় ম্যায়া ময়নার বিয়া দিছি। তারপরের দুই ম্যায়া শিউলি-বকুল, যমজ …।
রহমতের বউ, আল্লাহর কাণ্ডকারখানা দ্যাখো …।
কী রকম …!
তোমার ঘরে, ঘরবোঝাই অভাব। চাইল-ডাইল,
ত্যাল-মরিচের যে দাম, য্যান দোজখের আগুন, হাত দেওয়ার উপায় নাই, তোমার চার-চাইরডা বাচ্চা। আর আমার ঘর বোঝাই ট্যাকা, অথচ দ্যাখো, সন্তান নাই …।
ময়নার মা কিংকর্তব্যবিমূঢ়। কী বলা যায়, এখন, এই মুহূর্তে রিকশার মালিককে, ময়নার মা ভেবে পাচ্ছে না। আলিমুদ্দি হঠাৎ খপ করে ময়নার মায়ের হাত দুটো চেপে ধরলো।
ধরা-গলায় বললো – রহমতের বউ, না করিস না, তর শিউলি-বকুলের একটারে আমাগো দিয়া দে। ভাপ ওঠা
গরম-গরম ভাত পাইবো …।
দু-বেলা দু-মুঠো সন্তানদের খেতে দিতে পারে না ময়নার মা। কিন্তু তাই বলে ভাত-কাপড়ের অভাবে নিজের নাড়িছেঁড়া সন্তানকে অন্যের হাতে তুলে দেওয়া – ময়নার মা বললো – ‘এটটু ভাইবা দেহি, ভাই …।’
আলিমুদ্দি ময়নার মায়ের হাত ছেড়ে দিলো …।
দুই
আমি তাইলে যাই ময়নার বাপ। পাইলায় চাইড্ডা পান্তাভাত আছে, শিউলি-বকুলরে নিয়া খাইও …।
তুমি খাইয়া গেলা না …?
পাইলায় যা আছে, কইলাম তো পান্তাভাত, আসলে আছে খালি কিছু ভাত-ভেজানো পানি। যা আছে, তোমরা তিনজনে খাইও। আমি দেহি টিসিবির চাইল-ডাইল যদি কিনবার পারি, বাড়িতে আইয়া রাইন্দা-বাইড়া সবাই মিলা তহন খামু …।
ময়নার মা একটা ছালার ব্যাগ হাতে নিয়ে বাড়ি থেকে বেরিয়ে গেল। রহমত আলি আর কিছু বললো না। বলবেই বা কী? বলার মতো তো কিছুই নাই। বউ-বাচ্চাদের কামাই করে খাওয়ানোর কথা তার। কিন্তু সে তো তা পারছে না। আরো কতদিন বউয়ের ওপর নির্ভর করে বেঁচে থাকতে হবে, পঙ্গু মানুষের মতো, কে জানে …!
ভোরের আজান হয়নি। রাস্তাঘাট সুনসান। এতক্ষণ আকাশে মেঘ ছিল। শংকা ছিল যে-কোনো সময় বৃষ্টি নামতে পারে। এখন দক্ষিণ দিক থেকে বাতাস বইতে শুরু করেছে, মেঘ কেটে যাচ্ছে, বৃষ্টি নামার শংকাও। ময়নার মা দ্রুত-পায়ে হাঁটছে। ইউনিয়ন পরিষদে যাওয়ার, শিবপুর, মাধবপুর দিয়ে গেলে, পাকা রাস্তা আছে। কিন্তু ময়নার মা এই পাকা রাস্তা দিয়ে যাবে না। এটি ঘোরাপথ। তারচেয়ে বাড়ি থেকে বেরিয়ে খালপাড় দিয়ে সোজা গেলে পথ অনেক কমে যাবে। সুবিধা আরো আছে। খালপাড় দিয়ে গেলে কারো সঙ্গে পথে দেখা হওয়ার সম্ভাবনা কম। পাকা রাস্তায় ভোরবেলা অনেক মানুষ, যারা ডায়াবেটিসের রোগী, তারা হাঁটতে বেরোয়। অযথাই পথে নানাজনের অযাচিত প্রশ্নের মুখোমুখি হতে হবে। কী দরকার? তারচেয়ে ভাঙাচোরা রাস্তা হলেও খালপাড় দিয়ে যাওয়াই ভালো …।
ময়নার মা দুদিন ফিরে এসেছে, টিসিবির চাল-ডাল, তেল কিনতে পারেনি। লাইনে দাঁড়িয়ে ছিল দুপুর পর্যন্ত। কিন্তু তার সিরিয়াল আসার আগেই পণ্য ফুরিয়ে গেছে। খালি হাতে ফিরতে হয়েছে। দুধের বাচ্চা কোলে নিয়ে রোদে পুড়ে লাইনে দাঁড়িয়ে থাকাই সার হয়েছে। দিনটাই মাটি। এরচেয়ে সরকারবাড়ির ধানের চারা তোলার কামলা দিলেও লাভ হতো। অন্তত দুশো টাকা তো পাওয়া যেত। মহিলারা কাজ করতে গিয়ে কোথাও ন্যায্য মজুরি পায় না। পুরুষের প্রায় সমান কাজ করতে হয়। কিন্তু মজুরি অর্ধেক। দ্যাখো, এই যে ধানের চারা তোলা, এখানেও কত বড় বৈষম্য। পুরুষের মজুরি ৪০০ টাকা, মহিলাদের মজুরি ২০০ টাকা। তবুও তো ২০০ টাকা পাওয়া যেত। কিন্তু টিসিবির চাল-ডাল কিনতে এসে আম তো গেছেই, ছালাও গেল। এ-কারণেই আম-ছালা কোনোটাই যাতে না যায়, ময়নার মা ভোররাতে বেরিয়েছে। লাইনে সবার আগে দাঁড়াতে হবে …।
খালপাড়ে ঢুকতেই নূরু মোল্লা, কাশেম মোল্লা, আবেদালি মোল্লার সারিবদ্ধ শাকসবজির পালান। পালানের জাংলায় ঝুলছে অসংখ্য শসা, কুমড়ো। জাংলার ফাঁকে-ফাঁকে ঢেঁড়স গাছ। সব গাছেই বিঘৎ-খানিক লম্বা-লম্বা ঢেঁড়স আকাশের দিকে মুখ করে তাকিয়ে আছে। ঘরে চাল-ডাল না-থাক, বাড়িতে যদি পালান থাকত, পালানের জাংলায় ঝুলত শসা, কুমড়ো; গাছে গাছে ঢ্যাঁড়শ, এইসব রেঁধেও তো খাওয়া যেত। শসা তো কাঁচাই খাওয়া যায় …।
মোল্লাদের পালানে ঝুলন্ত শসা দেখে ময়নার মা নিজে-নিজে প্রলোভিত হয়। জিহ্বায় পানি আসে। গত সন্ধ্যায়
দু-মুঠো ভাত খেয়েছিল। সঙ্গে তিন-চার গ্লাস পানি। এখন তো না খেয়েই বাড়ি থেকে বেরিয়েছে। দুটো শসা ছিঁড়ে খেতে পারলে পেটের ক্ষুধা মিটে যেত। ময়নার মা এদিক-ওদিক তাকিয়ে দেখে। এই ভোরসকালে মোল্লাবাড়ির কেউ কি ঘুম থেকে উঠেছে। বাড়ির বউ-ঝিরা তো পটের বিবি। দাঁতে রোদ লাগিয়ে ঘুম থেকে ওঠে।
কামলা-জামলারা বোধহয় উঠেছে। গরুর চাড়ি দেবে। না, এদিকে পালানের দিকে এখনো কেউ আসেনি। দুটো শসা ছিঁড়তে আর কতক্ষণ। ময়নার মা কেবলই একটা জাংলার দিকে পা বাড়াবে, কোলের বাচ্চাটা চিঁহিহি করে কান্না শুরু করে। বাচ্চার কান্নাকাটি দেখে ময়নার মায়ের মেজাজ সপ্তমে ওঠে। জালিমটা আর কান্দার সময় পেল না। ময়নার মায়ের ইচ্ছে করছিল বাচ্চার গলাটা চেপে ধরে। হাতও নিজের সন্তানের গলা চেপে ধরার জন্য নিশপিশ করছিল। ক্ষুধার্ত মানুষের কি মতিগতি ঠিক থাকে? ময়নার মায়েরও মতিগতির ঠিক ছিল না। কিন্তু না, সে হাত গুটিয়ে নেয়। ছেলের গলা চেপে ধরার ইচ্ছাটাকে তখন চেপে ধরে। ছিঃ ছিঃ! এ কী চিন্তা তার মাথায় বেজাত ভূতের মতো চেপে ধরেছিল। বাচ্চাটাও তো ক্ষুধার জ্বালায়ই কান্নাকাটি করছে। নিজের মাইয়ে দুধ নাই। ঠিকমতো দুবেলা খেতে পেলে তো মাইয়ে দুধ আসবে? বাচ্চাটা ঠিকমতো দুধ পায় না। গরুর দুধ কি কৌটার দুধ কিনে খাওয়াবে সেই সামর্থ্যও নাই। কী দিনকাল যে পড়লো …!
কে যেন হাঁক ছাড়ে মোল্লাদের বারবাড়ি থেকে – এই, পালানের ধারে কেরা …?
ময়নার মা খালপাড় দিয়ে চুপচাপ হাঁটে। কথা বলে না।
এই, কে যাও এত সকালে, কথা কও না ক্যান …?
ময়নার মা ভীতসন্ত্রস্ত হয়ে ওঠে। সে কি দাঁড়াবে, দাঁড়িয়ে কথা বলবে, নাকি পা চালিয়ে হাঁটা শুরু করবে – হিসাব স্থির করতে পারে না। লোকটি যে মোল্লাদের কোনো কামলা, তাতে সন্দেহ নাই। মোল্লারাও ঘুম থেকে দেরি করেই ওঠে। তা কামলা ব্যাটা কি টের পেয়েছে – ময়নার মা জাংলা থেকে শসা তুলতে চেয়েছিল? ভয় এবং দুশ্চিন্তায়, শসা তো সে তোলেনি, তারপরও যদি চোর অপবাদ জোটে, সামান্য দুটো শসা খাওয়ার জন্য, ক্ষুধা নিবারণের জন্য; তাহলে তো মানইজ্জত বলে কিছু থাকবে না। ময়নার বাবাই বা কীভাবে নেবে বিষয়টি, তাও তো ভয়ংকর চিন্তার বিষয়। লোকটি কোমরের ব্যথায় ভারী কোনো কাজ করতে পারে না, আয়-রোজগার বলতে তেমন কিছুই নেই, তারপরও বউ চুরি করে কারো পালানের শসা খেয়েছে, বিষয়টি নিশ্চয়ই সে মেনে নেবে না। কপালে যা আছে তাই ঘটুক, ময়নার মা দাঁড়িয়ে পড়ে। চিৎকারের মতো করে বলে – ‘আমি …।’
– আমি কেরা …?
– আমি ময়নার মা …।
– ‘ও, ময়নার মা তুমি!’ ছোট মোল্লার বছর-কড়ালে কামলা সবদুল এগিয়ে আসে। বলে – ‘তা, এই
ভোর-বিহানে কই যাও, এই ছোট বাচ্চা নিয়া …?’
‘রাবনা ভোটঘরে যামু। টিসিবির গাড়ি আইবো। দেহি, যদি চাইল-ডাইল, ত্যাল-মরিচ কিছু যদি কিনন যায় …?’
– যাও। তা খুব নাকি ভিড় অয়, হুনি …।
– তা অয়। দুইদিন গেছি, দুপুর নাগাদ লাইনে খাড়াইয়া থাইকাও কাম অয় নাই। আমার পর্যন্ত ডাক আহার আগেই মালামাল শ্যাষ। খালি আতে ফিরা আইছি …।
– তা, ময়নার মা, তুমি কি হসা তুলবার চাইছিলা …?
– রাইতে কিছুই খাই নাই। জাংলায় হসা দেইখা ক্ষিদা চাগাইয়া উঠছে …।
– খাড়াও, ময়নার মা। তোমারে হসা তুইলা দিতাছি। খাইতে খাইতে যাও …।
সবদুল এক হালি শসা তুলে ময়নার মায়ের হাতে তুলে দিয়েছে তখনই নূরু মোল্লার গলার আওয়াজ পাওয়া গেল – ‘সবদুল কইরে, সবদুল …।’
সবদুল বললো – ‘পা চালাইয়া কাইটা পড়ো ময়নার মা। তোমারে হসা দিছি দেখলে মোল্লা হালায় আমার পিঠের চামড়া তুইলা ফালাইব …।’
ময়নার মা পা চালাইয়া খাল পার হয়ে, খালে পানি নাই, ঘটখটে শুকনো, ময়নার মাও জানে মোল্লাবাড়ির কাছে খালে পানি নাই, দ্রত বেহাড়াবাড়ির হালটে উঠলো। বেহারাবাড়ি, দাসবাড়ির গা-ঘেঁষে ভোটঘরের রাস্তা। সরু পথ। পায়ে হাঁটা। ভোটঘরে যাওয়ার মূল রাস্তাটি পাকা হওয়ার পর থেকে এই রাস্তায় লোক-চলাচল কমতে-কমতে এখন প্রায় শূন্যের কোঠায় নেমে এসেছে। রাস্তায় লোক-চলাচল না থাকলে রাস্তা মরে যায়। ময়নার মা মৃতপ্রায় রাস্তাটি ধরে দ্রুতপায়ে হাঁটতে লাগলো। এই রাস্তায় ভোটঘরে যেতে অন্তত আধামাইল রাস্তা কম হাঁটতে হবে। শসা চাবাতে-চাবাতে হাঁটছে ময়নার মা। দুটো শসা এরই মধ্যে শেষ করে ফেলেছে। আর দ্যাখো, কী অবাক কাণ্ড, দুটো শসা খেতেই ময়নার মায়ের স্তনে দুধ এসে গেছে। বাচ্চার মুখে মাই গুঁজে দিলো সে। ময়নার মা শসা খাচ্ছে, দেড় বছরের বাচ্চাটি বুকের দুধ খাচ্ছে; মা-ছেলে দুজনেই যেন এখন খুব সুখী। এটি তো প্রমাণিত সত্য, ময়নার মায়ের বেলায়ও যা ঘটছে, পেটে ক্ষুধা নিয়ে কেউই কোনোভাবেই সুখী হতে পারে না …।
বেহারাপাড়া, দাসপাড়া পার হলেই বাঁ দিকে বড় সড়ক। ডানদিকে পানাবিল। বড় সড়কে উঠতে-উঠতেই বিভিন্ন মসজিদ থেকে মাইকে ভোরের আজান ধ্বনিত হতে লাগলো। ময়নার মা হাঁটার গতি বাড়িয়ে দিলো। আজ সে লাইনের প্রথম দিকেই দাঁড়াবে। আর আধাঘণ্টার মতো হাঁটলেই ভোটঘর। কেবল আজান হচ্ছে, এখনো সূর্যের ঘুম ভাঙেনি, তার আগে আজ আর কেউ লাইনে দাঁড়াতে পারবে না। কাপড়ের আঁচলে হাত দিয়ে দেখলো ময়নার মা – টাকাগুলো ঠিকঠাক মতো আছে তো? আঁচলের গেরো খুলে টাকাগুলো, যে কষ্টের টাকা, কয়েক হালি মুরগির ডিম আর দুটো হাঁস বিক্রির টাকা, পড়ে গেলে আর বাঁচন নাই। না, টাকা আছে। এখন একটাই কাজ, লাইনে সবার আগে দাঁড়াতে হবে …।
ময়নার মা দ্রুত হাঁটছে। কোনো খেয়াল নাই কোনো দিকে। তৃতীয় শসায় কামড় দিতে গিয়েই তার মনে পড়লো – ময়নার বাবা রয়েছে, ধরতে গেলে দুদিন ধরেই অনাহার চলছে; রাতে যা খুদ-ভাত খেয়েছিল তাতে অনাহারিই বলা যায়, শিউলি-বকুলেরও একই অবস্থা, ঠিকমতো খেতে না-পেয়ে বাড়ন্ত বয়সের মেয়ে দুটোও কলার ফেতরার মতো শুকিয়ে যাচ্ছে, শসা দুটো বাড়িতে নিয়ে গেলে চাবাতে পারবে, ময়নার মা শসা দুটো খুতিছালায় ভরে ফেললো; এদিকে সূর্যমশাই রাস্তার পূর্বদিকের বর্গা, হাতিয়া, কাঞ্চনপুরের গাছপালা, ঝোপঝাড় ভেদ করে মুখ বের করছে, উপরের দিকে উঠছে, এতে করে রাস্তাঘাট কিছুটা পরিষ্কার হয়ে উঠছে; আর রাস্তা যতই পরিষ্কার হচ্ছে, ময়নার মায়ের বুক ধড়ফড়ও বাড়ছে। সামনে যে পিঁপড়ার সারির মতো মানুষের সারি; দেখা যাচ্ছে শুধু কালো মাথা। মাথাগুলো কচুরিপানার ছামের মতো যেন ভেসে যাচ্ছে নদীর ভাটির দিকে। এত মানুষ, এই ভোরবোলা কোত্থেকে এলো! সে তো ভেবেছিল – আজ আর তার আগে কেউ আসতে পারবে না; কিন্তু তার হিসাব যে সব গড়বড় হয়ে যাচ্ছে …।
সব মানুষের, নেহায়েত ধনবান লোক ছাড়া, খাদ্যাভাব সব বাড়িতেই। গরিব-গুরবো, নিম্নবিত্ত, নিম্নমধ্যবিত্ত মানুষ – তাদের তবু সামান্য সুবিধা আছে, কোথাও না কোথাও লাইনে দাঁড়াতে পারে, কারো কাছে হাত পাততে পারে, কিন্তু মধ্যবিত্ত মানুষের গোপন কষ্টের সীমা নাই। তারা না পারে টিসিবির লাইনে দাঁড়াতে, না পারে মেম্বার-চেয়ারম্যানের কাছে কোনো সুবিধার কার্ড চাইতে, সরকারের এই উন্নয়নের জোয়ারের সময় তারাই পড়েছে মহাবিপদে।
বিপদ আরো আছে, দেশের মানুষের যে অকথ্য খাদ্যাভাব, টাকার অভাবে ঠিকমতো বস্ত্রাদি কিনতে পারে না, অসুখে ডাক্তার দেখাতে পারে না; ছেলেমেয়ের লেখাপড়ার জোগান দিতে পারছে না – এসব দুঃখকষ্টের কথা কোথাও বলা যাবে না। দেশে যে এখন উন্নয়নের রেলগাড়ি ছুটছে, সরকারি দল যদি আরেকবার ক্ষমতায় বসতে পারে, দেশে উন্নয়নের রেলগাড়ি নয়, তখন বিমান ছুটবে; দেশে আকাল শুরু হয়েছে, এটা বলাও যেন পাপ! ময়নার মা তো দরিদ্রশ্রেণির লোক, সে যে-কোনো জায়গায় হাত পাততে পারে, টিসিবির লাইনে দাঁড়াতে পারে; কিন্তু মুশকিল হচ্ছে, এখন কোথাও হাত পেতেও কারো কাছে কিছু পাওয়া যায় না, কারণ, ময়নার মায়েরা যাদের কাছে হাত পাতবে, তাদেরই এখন হাত-পাতার মতো অবস্থা, তাদেরই এখন টিসিবির লাইনে দাঁড়াতে হয়। এজন্যই তো এই এত সকালে ভোটঘরের সামনে এত বড় লাইন …।
ময়নার মা বিষণ্ন মনে, ভাঙা শরীর নিয়ে, লাইনে এত মানুষ দেখেই তার শরীরটা আরো ভেঙে পড়েছে, লাইনে দাঁড়ায়। তার সামনে অন্তত দুশো মানুষ। কয়জন আজ মাল পাবে, কে জানে …!
সকাল ৯টার মতো বাজে। টিসিবির ট্রাক এখনো আসেনি। যেদিন ট্রাক আসে, ৯টা-সোয়া ৯টার মধ্যেই আসে। সেই হিসেবে টিসিবির মালের ট্রাক আসার সময় হয়ে গেছে। হয়তো এখনই এসে পড়বে। লাইনের লোকেরা সবাই তৃষ্ণার্ত কাকের মতো, যেন এখনই কোথাও পড়ে-থাকা ভাঙা-কলসিতে পানি পাবে; বড় রাস্তার দিকে তাকিয়ে আছে, যেমন কাক
ভাঙা-কলসিতে পানি পায়, তারাও টিসিবির ট্রাক এলেই চাল-ডাল, তেল, আলু ইত্যাদি পাবে …।
কিন্তু দশটা বেজে গেল, ট্রাকের দেখা নাই …।
– ট্রাক কি আইজ আবো …?
– কেরা জানে, আবো কি আবো না …?
– সপ্তায় তো দুইদিন আহে। রবি আর বুধবার। রবিবারে আইছিল। আইজ বুধবার। তাইলে আবো না ক্যা …?
– আবো না যে ক্যা, তা কই ক্যামনে। সরকারের ঘরে চাইল-ডাইল আছে কি নাই, তাই বা কেরা জানে …?
– কোন দেশে-দেশে নাকি যুদ্ধ লাগছে, তাইতে আটা-ত্যালের দাম বাইড়া গেছে …।
– থও ছে দেহি এই প্যাচাল! চোর। সব ব্যাটা-শালা চোর। চোরের দ্যাশে সব জিনিসের দাম বাড়বো, দেশে আকাল পড়বো, আমরা না খাইয়া চামচিকার মতো চিমটা ধইরা মরমু, এইডাই নিয়ম …।
– হায় হায়! এইডা কি কও? দেশে আকাল পড়ছে, মানুষ না খাইয়া চিমটা ধরছে – এইডা কওন যে পাপ! আল্লায় বেজার অবো …।
সকাল সাড়ে দশটা বাজে। তীব্র ভ্যাপসা গরম। শরীরে যেন ফোস্কা পড়ে যাবে। লাইনে দাঁড়িয়ে থাকা কঠিন। হঠাৎ শোরগোল বেঁধে গেল। ট্রাক এসেছে। মালের ট্রাক এসেছে। লাইন ভেঙে গেল। কে কাকে কনুই মেরে, ধাক্কা মেরে লাইনের সামনে দাঁড়াবে – এই নিয়ে যেন যুদ্ধ লেগে গেল। ইউনিয়ন পরিষদের চৌকিদাররা লোকজনকে সোজা করে লাইনে দাঁড় করাতে ব্যর্থ হয়ে কিছুটা তফাতে গিয়ে দাঁড়িয়ে রইল। যে চাল-ডাল পায় তো পাক, না-পায় তো না-পাক। তাদের কী? শালিরা ধাক্কাধাক্কি করে, চুলোচুলি করে, চিৎকার-চেঁচামেচি করে ঠান্ডা হোক। তখন একাই সোজা হয়ে লাইনে দাঁড়াবে …।
তখনো লাইন সোজা হয়নি। ধাক্কাধাক্কি, চিৎকার-চেঁচামেচি চলছেই। হঠাৎ এক নারীর গগনবিদারী আর্তচিৎকার – ‘ওই হতিনেরা, আমার পোলাডা মরলো তো, আমার পোলা …।’
এই চিৎকার ময়নার মায়ের।
ময়নার মা প্রাণপণ চেষ্টা করছিল – সামনে যাবে। লাইনে ময়নার মায়ের সামনে যত লোক, টিসিবির ট্রাক আসার আগেই যারা লাইনের সামনের দিকে দাঁড়িয়েছিল, তাদের পেছনে ফেলে ময়নার মা সামনের দিকে যাবে, এই সুযোগ বা শক্তি তার ছিল না, কিছুটা দূরেই সে লাইনে দাঁড়িয়ে ছিল, এরই মধ্যে ট্রাক এসে গেলেই হুলস্থূল বেঁধে যায়, কে কাকে কনুই মেরে পেছনে ফেলে সামনে যাবে – এরই প্রতিযোগিতা শুরু হয়ে যায়, ময়নার মাও সেই চেষ্টা করছিল, কিন্তু দুদিনের আধপেটা খাওয়া ময়নার মা সামনে যাওয়ার চেষ্টা করে খেই হারিয়ে ফেলে, উপুর হয়ে পড়ে যায়; তখন কোথায় যেন ছিটকে পড়ে তার কোলের বাচ্চা …।
‘আমার পোলা কই, পোলা কই’ বলে ছোটাছুটি শুরু করে ময়নার না। ছিটকে পড়া বাচ্চাটি যদি এই হুলস্থূলের মধ্যে কারো পায়ের নিচে পড়ে, তাহলে আর রক্ষা নাই। এরই মধ্যে অল্পবয়স্ক এক মহিলা বাচ্চাটিকে ছোঁ মেরে আরেক মহিলার পায়ের নিচ থেকে তুলে নেয়। আরেকটু হলেই বাচ্চাটি ওই মহিলার পায়ের নিচে পিষ্ট হয়ে মারা যেত। অল্পবয়স্ক ওই মহিলা চিৎকার করে বলে – ‘চাচি, এই যে তোমার পোলা …।’
ময়নার মায়ের এতক্ষণ কোনো হুঁশ ছিল না। দুধের বাচ্চা মৃত্যুর মুখ থেকে ফিরে এসেছে, বাচ্চাটি কোলে নিয়ে সে জ্ঞান হারিয়ে ফেলে …।
তিন
সেদিন রাত ৯টা কি ১০টা হবে। গুঁড়িগুঁড়ি বৃষ্টি। দুপুরের পর থেকেই ঝুমবৃষ্টি হচ্ছিল। ময়নার মা আজো টিসিবির মাল কিনতে পারেনি। বৃষ্টিতে ভিজে বাড়ি এসেছে। কোলের বাচ্চার প্রচণ্ড জ¦র। মানুষের পায়ের নিচে পড়ে মরতে বসেছিল বাচ্চাটি, সেই ভয়, বৃষ্টিতে নাকানিচুবানি খাওয়া – বাড়িতে ফেরার পরপরই বাচ্চাটির যে জ্বর এসেছে, তা এত রাতেও, ময়নার মা বাচ্চার মাথায় অনেক পানি ঢেলেছে, তখনো জলপট্টি দিয়ে রেখেছে, কিন্তু জ্বর নামছে না। ঘরে আজ একমুঠো চাল কি খুদ কিছুই নেই; রান্নাবান্না কিছুই হয়নি, রহমত আলী, শেফালি-বকুল সবাই শুয়ে পড়েছে, না-খেয়েই। ওরা ঘুমিয়েছে কি ঘুমায়নি, কে জানে! খালি পেটে কি ঘুম ধরে। হয়তো ওরা ঘুমের ভান করে পড়ে আছে। জেগে আছে শুধু ময়নার মা, জ¦রগ্রস্ত কোলের বাচ্চাকে সে জলপট্টি দিচ্ছে, আর ভাবছে – মোল্লাদের পালান থেকে গোটা কয়েক শসা চুরি করে আনলে কেমন হয়! দুটো করে শসা খেলেই পেট ভরে যাবে। দুপুরের পর থেকে বৃষ্টি হচ্ছিল, এখনো গুঁড়িগুঁড়ি বৃষ্টি হচ্ছে – এখন মোল্লাদের পালান থেকে শসা চুরি করে আনলে কেউই টের পাবে না। ক্ষুধা বড়, না পাপ বড়? ময়নার মায়ের এই শসা চুরির ভাবনার মধ্যেই তার কানে এলো কে যেন তাকে ডাকছে – ‘ভাবি, ও ভাবি, ঘুমাইছ নাকি?’
– ক্যারা? এতো রাইতে ডাকে ক্যারা?
– চুপ। আস্তে কথা কও। আমি আলিম মেম্বার …?
– মেম্বার সাব? আপনে এত রাইতে …?
– দরজা খোলো। ভিজা গেলাম।
ময়নার মা হারিকেনের সলতে একটু বাড়িয়ে ঘরের দরজা খুললো।
– এত রাইতে কী কন? এই বৃষ্টিবাদলার মধ্যে…।
– রহমত ভাই ঘুমাইছে?
– ঘুমাইছে, মনে অয়?
– বাইরে আহো। চাইল-ডাইল নিয়া আইছি।
– চাইল-ডাইল?
– ডাইল দিয়া গরম-গরম ভাপ-ওঠা ভাত খাবা।
ময়নার মা জানে, সে তো কচি খুকি নয়, ভাপ-ওঠা গরম ভাত খাওয়ার বদলে আলিম মেম্বারকে কী মূল্য দিতে হবে। তবুও সে মেম্বারের সঙ্গে অন্ধকারের মধ্যে বেরিয়ে গেল…।