শুক্রবার , ১০ই অক্টোবর, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ

গল্প

জাহালম গাছির গন্তব্য

ত্রিভঙ্গ মুরারি খাঁজকাটা কণ্টকময় বৃক্ষ। একখান দুইখান না, সার সার। সুখে-দুঃখে তারা একাট্টা। জাহালমের খাজুর বাগান। ভদ্দরখোলের ছাওয়াল-পাওয়াল বুড়া-জোয়ান কেডা না চেনে। উত্তরা বাতাসের আগমনের আগ দিয়াই জাহালম গাছি কাছা মারে, শক্ত গিট্টু। ধেয়ানে থাকে গোটা হিমানি দিনগুলায়। রসের ধেয়ান, জিরান কাটা পাটালি গুড়ের ধেয়ান।

ওস্তাদ গাছি। খেজুর গাছে ঠিলা লাগায়া রস নামান পানির মতো সোজা সিধা কারবার না। এলেম লাগে, চিকন কায়দা লাগে। গাছির একিন হয়, তার হাতযশ মাওলা মাবুদের দয়া। বাপ-দাদার পরহেজগারি। ভিটার চারকোলে গাছলতার ঝামুর-ঝুমুর। পক্ষীসকল দুয়ারে খুদ খুঁটে খায়। অবসরকালে জোয়ান জাহালম একদণ্ড গোল হয়ে বসে। থুঁতনির নিচে হাঁটু ঠেকায়া তামশা দেখে। দুনিয়া ভাবের পাগল। চরকিবাজি।

প্রান্তরে, পাছদুয়ারের টলমলা পুকুরের কোলে কতশত বৃক্ষের শোভা রে। সোনালুর হলদা ঝুল ঝুল ঝাড়বাতি, ভাঁটফুল, তেলাকুচার লতাটারেও সে আপন জানে। তার চোখে স্বপ্ন নামায়। মায়া জাগায়।

চারুবালা দাসী থুড়ি নবিতুন নেসার একজনই নাতিধন। নবীন গাছির ডিল নকশার গুনগান করে মানুষজন। শ্যামলাবরণ দেহ, চিকনাই ঝলসায়। মাথাভরা চুলের বাহার, যেন বা সর্পের ফণা। মনে হয় ঠাডা পড়লেও চমকায় না – ভড়কায় না। এমন তার চলন-বলন। মজবুত বেটা ছাওয়ালডা। অন্তরডা রাখে ঠান্ডা শীতল। আবার নাকি সময়মতো আগুনগরম হওয়ার পারে। নিজেরে খানিক তোয়াজও করা লাগে। এইডা তার নিজ মনের বুঝ। মুন্সিবাড়ির গাছি।

এই যে এই জলা-জঙ্গলার দেশে ছয় কিসিমের রং-তামাশার কেরামতি। এই সকল গ্রীষ্ম, বসস্যা, শীতল দিনগুলার মনপুরানি নেশা জাহালমের যুবক মনের আকুলিবিকুলি। সাধ-আহ্লাদের মচ্ছব।

হিমের দিনগুলার তরে তার হা-পিত্যেশ। মটরকলাইয়ের ক্ষ্যাতে কুয়াশা নামার আগেই গাছির গোছ মিছিল শুরু। সে ঠিলা-কলসি, হাঁসুলি, কাছি, নলি সাজায়। নলি, ঠিলা নিজ হাতে সাফ-সুতরা করে আর গুনগুনায়, মানুষ বানাইয়া খেলছ তারে লইয়া/ সেই মানুষে কেমনে গোনা-গা-র।… জোস উথলায়।

দরদি গাছি খাজুর বাগানে হাঁটে বিয়ানবেলায়, সাঁঝের কালে। একলা একা। কোনোদিন কামলা গেদামিয়া পেছন পেছন হাঁটে। ঝাঁকড়া চুলের খাজুর গাছগুলারে আগা থেকা মাথা পর্যন্ত পরখ করে, চক্ষু দিয়া মাপজোক করে। কোন গাছখান বশে নাই। ব্যারাম ধরছে শরীলে। কোনডা খোশমেজাজে রইসে। রসের নহর নিয়া কোমর কাত কইরা খাড়াইয়া রইছে। কোনডা মরদ, কোনডা বেটিগাছ – সকল নিকেশ নোখের ডগায় ঝিলমিল করে।

গাছের ছালে চাঁছ দিতে যায়া জাহালমের অন্তর যে বেদনা অনুভব করে না, বিষয়ডা তেমন না। আদরের গাছের বাকল কায়দা করে চিরা ফেলা লাগে। পেরেক গাঁথা লাগে। নিজ হাতে ধার দেওয়া চকচকা ছেন দাওখান দিয়া।

গাছরে খানিক জিরান দিয়া জিরানকাট রস তার চাইতে ঠিলা ভরা আর কেডা নামাইতে পারে ভদ্দরখোলে?
দো-কাট রস, ঝরা রস ঠিলা-কলসি টুবুটুবু। হাটবারে হনহনাইয়া হাঁটা ধরছিল জাহালম। ঝাঁকায় ঝাঁকায় গুড় সাজাইছিল ওস্তাদ গাছি। খরিদ্দার বিদায় করতে দুই কামলা, নিজে একেবারে হয়রান। নিয়াস ফেলার কায়দা নাই। তার গুড় হাটের সেরা।

পিছন থেকা মুরুব্বি জয়নুল মাস্টারসাব ডাক দিলেন, ‘জাহালম বেটা তুমি বাপধন কামাল করছ। মানিকগঞ্জের ঝিটকার হাজারি পাটালি গুড় ফেল। রানি এলিজাবেথ নাকি খুশি হয়া ওদের সিলমোহর দিছিলেন। বোঝ। তাইলে তোমারে পুরস্কার দেওয়া লাগে।’ গাছির চোখ ছলছল করে। তার মৌলবি বাপের খাস দোস্ত মাস্টারসাব। ঝপ করে কদমবুচি করে জাহালম। কোন ধেয়ানে হিমানি দিনগুলায় সে রস নামায়, গুড় জ্বাল দেয় আল্লাহপাক মাবুদ ভালো জানে। কষ্ট করিলে কেষ্ট মিলে। সুরাতন বিবি উঠতে বসতে কেষ্ট ঠাকুরের কথা কয়।

চিরল চিরল কাটা খাজুর গাছগুলারে এক ধেয়ানে দেখে জাহালম – দগদগা হলদা ঘাও গো। কিন্তুক এই গুড়ের ব্যবসা তার বাপ-দাদার। তার দাদার ভিটার উঠানডা দিঘালে পাথালে মস্ত। গুড় জ্বালে চড়ে, সুবাস সর্ষা ক্ষ্যাত টপকায়া মায়মুনাদের দুয়ারে যায়া আছাড়ি-পিছাড়ি খায়! কী পরবডা লাগে যে। এত ফুর্তি কই রাখবে সে!
বাপ-দাদার চাইতেও তার হাতযশ অধিক। তেনারা গুড় করছেন, মসজিদে ইমামতি করছেন। চিল্লায় বসচেন। মাহফিলও করছেন।

সত্যই ওস্তাদ গাছির গুড়ের ঘেরান মিয়া বাড়ির দুয়ারে যায়া মায়মুনা পরীরে খানিক উতলা করে নাকি, হেইডা বুঝার জন্য মজনু পাগলা নরম গুড়ের নমুনা খোড়ায় নিয়া হাঁটা ধরে।

দুয়ারে কমলা গেন্দা ফুল হাসতাছে। ফিসফিস করে গাছি, ‘সালামালেকুম গেন্দাফুল। ঘরের মধ্যে যে আর একটা সুন্দরমতো গেন্দা ফুইটা রইছে সেইডার খবর কও।’ পাগলা আপনমনে হাসে।

পা বাড়াতেই মায়মুনার মা। উপুড় হয়া কদমবুচি করে জাহালম। মিয়াবাড়ির বড় বিবিসাব। পরীডার মা। সোন্দর মানুষ, চেহারায় খানিক দেমাক ঝিলিক মারে।

জাহালম মাটির খুড়িটা কায়দা করে এগিয়ে ধরে, ‘দেহেন তো চাচিআম্মা গুড়ের পাক ঠিকঠাক আসচে নাকি?’ হুমায়রা বিবি এক চিমটি মুখে দিয়ে খোশমেজাজে কয়ে ওঠেন, ‘স্বাদে গন্ধে ভালো হইতাছে বাপু। এইবারে সাত কেজি পাটালি দিও জাহালম। শীতের মধ্যে কুটুমরা সব আওয়া-যাওয়া করবেনে।’

এইখানে কিঞ্চিত শানে নজুল। চারুবালা দাসী জাহালমের দাদিজান হয় কেমনে? শাস্তর, না সত্য। মানুষের সঙ্গে মানুষের গিট্টু মহব্বত চেরকালের।

চারুবালা একাত্তরের ভোররাতে নজিবুর মুন্সীর ঘরের চৌকাঠে লুটায়া পইড়া আছিল। গোলাপ ফুলডা জানি কোন দুশমনের দুশমন ছিঁড়া আনছে। বেহুঁশ কইন্যা।

মুন্সীর প্রথম পক্ষের বিবি ইন্তেকাল করছেন। বাইতুল নাজাত জামে মসজিদের পেশ ইমাম মুন্সীর দয়ালু মনও কান্দে। ময়-মুরুব্বি দশজনে মিলঝিল হয়া কলেমা পড়ায়া দুঃখী এতিম মেয়াটারে মুন্সীর বিবির খালি জায়গাডা পূরণ কইরা দিলো। চারুবালার বাপ ভাই মা ঠাকুমা ভিটেমাটি অঙ্গার। মিলিটারি, জানোয়ারগুলা নরকের তাণ্ডবে ছাইভস্ম করছিল অগুন্তি ভিটামাটি জনমানুষ। আহারে।

চারুবালা নবিতুন নেসা বিবি হয়া বিরাজ করে সংসারে। মানুষে মানুষে অচিন মহব্বত। মানুষে মানুষে চেরকালের গিট্টু। কইন্যা চারুবালা আছিল সোতের শ্যাওলা। অসহায়। নবিতুন নেসা বিবি পাইল কলেমার সাহস – পায়ের তলায় শক্ত মাটি। সুখে-দুঃখে দিন যায় – চারুবালা অতীত ভোলে। নবিতুন বিবি রান্দে বাড়ে। পালানে কুমড়া, লাউ ফলায় কিছু।

বিহান বেলায় পদ্ম ফুলের ডালি পয়দা হলো। কইন্যা জন্ম নিল। নবিতুনের পরম পুতলা। টগর ফুল কোলজোড়া। মুন্সি নাম রাখল সুরাতুন নেসা। ধুমধামে আকিকা হইল। গাঁয়ের মানুষ জানভরা গোস্ত ভাত খাইল। মুন্সির দরদ মানুষের জন্য।

নতুন বাপ চোখে হারায় মেয়ারে। মেয়া ডাগরডোগর হইয়া উঠতাছে। লাউয়ের ডগাডার মতো তার বাড়বাড়ন্ত।

দিন গড়ায় – সুরাতুনের তিন কবুল হয় নজিবুর মুন্সির চাচাতো ভাইয়ের পুত্রধন সিরাজুল মুন্সির সঙ্গে। ঘরজামাই। সিরাজ মুন্সিও জামে মসজিদে ইমামতি করে, সুরুজ মুন্সির পড়া পানির জন্য ভিড় জমে জুমাবারে। মুন্সিবাড়ির চওড়া বৈঠকঘরে। সিরাজরে ভদ্দরখোলের জনমানুষ সুরুজ মিয়া ডাকে। ফেরেশতা কিসিমের মুন্সি।

নজিবুর মুন্সি ইন্তেকাল ফরমাইলেন। নবিতুন বিবি

জমি-জিরাত, খাজুর বাগান দেখভালের দায় নিয়া খানিক দিশাহারা। মুন্সিবাড়ির খাজুর বাগানের পুরানা কামলা তোতা মিয়া, রামকানাই শলা দিয়া সাহস দিয়া খাড়া রইল।

দিন ফুরায় – জগতের নিয়মে। সিরাজুল সুরাতুনের ঘরে চাঁদের আলোয় ঝিলিমিলি। জাহালম আসল। দিন ছলবল কইরা হাঁটা দেয়। …

শাওন মাসের এক রাতে এশার নামাজের জামাতে আল্লাহপাক তুলে নিল সুরুজ মুন্সিরে। জনে জনে মাতম, কান্দনে জারে জার। মুরুব্বি বিহনে পাড়াপড়শি এতিম। কে দিবে দোয়ার ফুঁক। কামেল আছে কোনখানে।

জাহালম সবে পনেরো বছরের। মা দাদির দিশা নাই। মায়ের বুকে মাথা গুঁজে কান্দে ছাওয়াল, ‘তেনার হায়াত, আয়ুকাল ফুরাইছিল বেটা। বুক বান্দো। খাড়া হও।’ সুরাতুন বিবি আনমনা। বিবি হুতাশনে – অন্য দুনিয়ায় মন ভাসায়। সংসারে মন নাই।

জোয়ান মরদ হইসে জাহালম। বিবাহের ফুল ফোটার সুসময় বইয়া যায়। দাদিজান সংসার সামাল দিতে দিতে কিঞ্চিত বাউলানি। মন-মগজ কোন নিধুয়া পাথারে হারায়া যায়। মাঝে মধ্যে জ্ঞাতি দিদি সুহাসিনী আসে পঞ্চকোশী গ্রাম থেকা। দুয়ার আটক করে কত কথা গালগল্প হয়, মাবুদ জানে। কত কথা থাকে মানুষের বুকের সিন্দুকে। ভাবে জাহালম।

জাহালম মায়েরে তালাশ করে, পায় না। পায় একজন বেদরদি কাঠের পুতলা। তার মগজে নাকি মাঝেমধ্যে কেমন আউলা লাগে।

মায়ে ঝিয়ে খিড়কি দুয়ারের তুলসিতলায় জল দিয়ে বিড়বিড় করে। কী কয় বিড়বিড় কইরা তারাই জানে। নবিতুন বিবির ভুল হয় না তুলসিতলায় সন্ধ্যাবাতি দেওয়ার। একটু আড়াল লুকাছাপা চলে। …

সূর্য রাঙা আলোয় মুন্সিবাড়ির উঠানে নকশা আঁকতাছে। মায়মুনা পরীডা সঙ্গে সোহাগী, জামাইল্ল্যা খাড়া। স্বপন, না সত্য! জাহালম চায়া থাকে। বুকের মধ্যে বাদ্য বাজে ধিরিম ধিরিম।

বুঝি শীতকালে কোকিলা ডাকে, ‘এক ঠিলা রস লাগব মুন্সি ভাই।’ বিয়ানবেলার রস সব চুলায় ফুটতাছে। জাহালম নিচা গলায় কয়, ‘কাল বিয়ানবেলার দুই ঠিলা রস আমি দিয়া আসবোনে মায়মুন।’ পরদিন কুয়াশা কুয়াশা ভোরবেলা। হাঁটা দিবে নওজোয়ান মিয়া বাড়ির চাতালে –

ঘটনা ঘটে – রসের ঠিলাডা নামাইয়া জাহালম সাহসের ঘোড়া দাবড়ায়। মায়মুনার খালারে শরমের মাথা খাইয়া কয়াই ফেলে, ‘খালাম্মা আমি মায়মুনারে ঘরে নিবার চাই।’ খালা বুঝি ভিমরি খায়। এমন নিলাজ ছাওয়ালডা।
ময়-মুরুব্বি নাই।

পরদিন কুয়াশার ঘেরের মধ্যে দুয়ারে পরীডার খালুজান। কয়ডা কথা শুনায়া হাঁটা দেয়। বাজ পড়ল বেটা ছাওয়ালের মাথায়। ‘তুমি বাপু দোআঁশলা মানুষ। তোমাগর সাথে সম্বন্ধ করে কেডা? মিয়াবাড়ির মেয়ার খানদানি বংশ লাগে।’

দাদিজানরে দেখলে আচমকা পিত্তি জ্বলে। মাওডা তো খালি পেডে ধরছে। এহন কেমন ভাবের দুনিয়াত থাকে। সেইদিন দাদি মেয়ার চুলের জট ছাড়াইতে ছাড়াইতে অমাবস্যা পুন্নিমার হিসাব কইতাছিল। বেনি গাঁথা হলে মা উঠে দাঁড়াতেই কোল থেকা একখান দশভুজা দুর্গার প্রতিমা মাটিত পড়ল।

জাহালম এক ঝলক দেইখা বাইর বাড়িত হাঁটা দিলো। ঝিম ধরা মগজের ভিতরে আন্ধার, কিসের এক জিদের ধিকিধিকি আগুন। কেমন আউলা দশা। দাদিজানের ডাকাডাকিও ভালো লাগে না তার। দাদি এখন একটু কুঁজা হয়ে হাঁটে। নরম হয়া গেছে। ‘জাহালম ভাতে বলক আসচে। শোলমাছ নতুন আলু দিয়া রানছি। আয় খাইতে। বেলা গড়ায়া যাইতাছে। শুক্তা রানছি। আয় কলাম। জুড়ায়া যাইতাছে।’

দাদির মোলায়েম ডাক তার কানে ঢোকে না। যে জাহালম খিদা পাইলে পাগলা পাগলা হইয়া যাইত। বাপ-বেটায় লোকমা পাকায়া পাকায়া ভাত খাইত।

দোস্ত খায়েরের বাড়িত যায়া বসে থাকে গাছি। রস নামান, গুড়ের চুলা জ্বলে না। ঠিলা, কাছি, ছেন দাও মাচায়।

দোস্ত কয়ডা কথা না কয়ে পারে না। কষ্ট হয় তাও আসল কথা কইতে হয়। সবুর প্রামাণিকের ডাগর মেয়াটার জন্য প্রস্তাব দিছিল সেও। কুলসুমের নানি কইছেন, ‘হেগরে রক্তের মধ্যে দোষ ঢুকছে।’

বাপধন ইন্তেকাল করছেন আর এইসব বাও বাতাসের ঝাপটা। হায়রে মুন্সির দোয়া-কালাম ঝাড়-ফুঁক এ-তল্লাটে কেডা না নিছে। এই যত নয়া হেদায়েত শোনা লাগে রে, কপাল।

জাহালম জোয়ান মর্দ বিবাহ হয় না। মনে ভাবনার ঘোলা পানির বান। দাদিজানের রক্ত লাল, আমার রক্ত লাল। মায়ের রক্তে কোনো তফাত নাই। মানুষে মানুষে এত ঘিন্না কেমনে করে। এহন নানা কেচ্ছা গজাইতেছে।

জুমার নামাজে পাঁয়তারা জাহালমের। বাপের আচকান পরনে। পাঁচকল্লি টুপি মাথায়। আতর মাখায় কানের লতিত। জুমাঘরে গিয়া সবে পা রাখছে। আচমকা জোলাপাড়ার নুরা গুণ্ডা পিছন থেকা ঘাড় বেঁকা কইরা কথা কয়, ‘আপনে তো ধুতি পরবেন, কাছা দিয়া। পরেন না, আমরা তামেশা দেখুম। আইচ্ছা হেরা মানে ওই কঞ্জুস মালাউনরা গোবর মুখে দেয়, বিধান আছে তাগর কিতাবে? ওহ্ শুনছি গোমূত্র -’

আর খাড়া থাকতে পারে না ওস্তাদ গাছি। অসুরের দাপাদাপি তার চওড়া সিনায়। শিরদাঁড়া সিধা করে আগায়। নুরা গুণ্ডা পলাইতে পলাইতে কয়, ‘দেখছি তর দাদিরে দুর্গাপূজার মণ্ডপে ঘোমটা দিয়া এককোনায় খাড়ায়া থাকতে। দেখছি পরসাদ আঁচলায় বানতে। মিত্যা কই নাই। হিরু, কানাই ওরাও দেখছে। বাহাদুরি মারাইও না।’

ঘরে ফিরে জাহালম কান্দে জারেজার। পুরুষ মানুষের কান্দন! হিক্কা ওঠার দশা।

এ-জীবন নাড়া পোড়ার ধোঁয়ায় আন্ধার। খাজুর বাগান মনোহারি মোকাম কোনোডায় মন নাই। কাম ছাড়া জাহালম তো জাহালম না। অচিন মানুষ।

আগেপাছে আর কি ভাবনা। জাহালম হাঁটে – ক্রোশ ক্রোশ – রানি দিঘি, মনসা মন্দির, পুরানা বড় মসজিদ ছাড়ায়া ভদ্দরখোলের শেষ মাথায়। দোস্ত মাহাতাব সেও ওস্তাদ গাছি, ছোটকালের খেলার বান্ধব।

চাঁদনি বিবির বহুত কেচ্ছা সে কইছিল। কানে তুলা দিয়া আছিল জাহালম। আজ তুলার টোপলা ফেলায়া দিছে। দোআঁশ জাহালম চাঁদনির দরজায় কড়া নাড়ে।

ঝোপঝাড়, বাবলা গাছ, বাঁশঝাড়ের ঘন ছায়ায় চাঁদনির এক উঠান। এক ঘর। একটুখানি ফুলের বাগান। বিকালবেলায়ই ঘুঘুর ডাকে বুকের মধ্যে হুসাশন ওঠে। কিন্তু সে আসছে অন্য ঠিকানায়। সুখের চোরাবালির দিকে – মোমের পুতলার দিক নজর যায় গাছির। এ কি মেয়ামানুষ নাকি হুরপরী। সারা শরীরে কিসের ঢেউ উথলায়। এমন ছলবলা মেয়ামানুষ নাকি হয়, আগে দেখে নাই। জাহালম, ওস্তাদ গাছি। মুন্সিবাড়ির ছাওয়াল।

এক টোপলা পাটালি গুড় টেবিলে রাখে জাহালম। আলগোছে। মোহিনী আগুন রূপসী অকারণ দমকে দমকে হাসে। আগুনের ফুলকি। সারা শরীরে যমুনার বান। নজর চরকিবাজি খেলে। জাহালম হলকুমের কাছে দলাদলা কান্দনের গুটলি। কেন যে!

বাপজানের নুরানি চেহারা ভাসে। চাঁদনি মাদকতাময় গলা ঝনঝন শব্দে বাজে – ‘রসের নাগর আইসচেন দুয়ারে। কুনজ সাজাও গো।’ কত নাগর দিন রাত আসা যাওয়ায় -! জয়নাল নাকি তার স্বামী! কলেমা পড়া বেটা না কিন্তু। পান-জর্দা, মিঠাই-মণ্ডা, কেরু কোম্পানির দেশি মাল মজুদ।

এইখানে রক্তের টিকিট লাগে না। জাহালম থম মেরে বসে থাকে। ঘরের মধ্যে মায়াবি আলোর নকশা। ভুর ভুর করে সুবাস। ফুলদানিতে তাজা কয়টা রক্ত গেন্দাফুল। আর বড় একটা পিরিচে কমলা রঙা গেন্দাগুলা। সবখানের গেন্দাফুলের হাসিডা একরকমের মালুম হয়। মায়মুনাদের দরজায় চ্যাগারের বেড়ার ফাঁকে এমনই কয়টা গেন্দা ফুল ফুটে ছিল। জাহালম বিড়বিড় করে, ‘সালামালেকুম গেন্দাফুল।’


আরও