শুক্রবার , ১০ই অক্টোবর, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ

গল্প

জাদুগাড়ি

শেষমেশ আলী আক্কাস যখন ঠিক করে ফেলল কপালে যা আছে, বাড়ির ভিটি বেচে হলেও একটা ব্যাটারি রিকশা কিনে ফেলবে, বউ রমিজা আল্লা গো, এইডা কী কও বলে আঁতকে উঠলেও সে শোনার গরজ দেখাল না। চিন্তাটা এক-দুদিনের না, অনেকদিন ধরেই মাথায় ঘুরঘুর করছে। রোজ সকালে মহাজনের গাবতলি গ্যারেজ থেকে প্যাডেল রিকশাটা বের করে রাস্তায় নামতেই মনটা দমে যায় – যেদিকে চোখ যায়, ব্যাটারি রিকশার রমরমা। নিজের রিকশায় পা দাবাবে কি, সে হাঁ হয়ে ব্যাটারিওয়ালাদের কাজকারবার দেখে। একেকটার কী ধুন্দুমার রোয়াব! আর ড্রাইভারের সিটে বসা নবাবজাদারা দুদিন আগেও যে কোমর-হাঁটুর কলকব্জার বারোটা বাজিয়ে
রোদ-গরমে তেনা-তেনা হতো, এখন তাদের দেখে তা কে বলবে! আর প্যাসেঞ্জাররা তো আজকাল ব্যাটারি ছাড়া কিছু বোঝে না। প্যাডেলওয়ালারা রাস্তার কিনারে রানিখেতে কাবু বিমারি মুরগির মতো ঝিমায়, গামছা দুলিয়ে
লু-হাওয়া খায়, নয় সিটে পাছার বদলে পা তুলে ঘুমায়। তার নিজের অবস্থাও একই, তবে সে যে ব্যাটারির ধান্ধায় আছে, এ-চিন্তা মাথায় এলে ভেতরটা কুলকুল করে ওঠে।

রমিজাকে বলার কিছু নাই। মাদারীপুরের উজানঢাকিতে বাপ-দাদার ঠিকানা বলতে দেড়-পৌনে দুই শতকের ভিটি বলতে একটা খড়ের একচালা। একচালাটাও তার নিজের করা না। খালি পড়ে আছে বলে পড়শি নেয়ামত খনকার তাকে বলেকয়ে খড়ের একচালাটা তুলে তাতে গরু-ছাগল রাখে, মাস গেলে দেড়শো-দুইশো বিকাশে পাঠায়। খনকার অনেকদিন ধরে ঝুলোঝুলি করছে, দে না বাপ, আমারে দে, ন্যায্য দাম পাইবি। তুই কি এইখানে কুনুদিন ঘর তুলবি?

নেয়ামত খনকারের সাধাসাধিতে এতদিন কান দেয়নি আক্কাস, যদিও জানত তার কথায় ভুল নাই – সে কোন দুঃখে শহর ছেড়ে ওখানে ঘর তুলতে যাবে! তাই বলে বেচে দেওয়ার চিন্তাও মাথায় চাপেনি। চাপল ব্যাটারির টানে। বউ রমিজার আবার মাথায় অন্য খেয়াল, সে গেরস্ত ঘরের মেয়ে, নদীভাঙায় বাড়িঘর খুইয়ে আক্কাসের সংসারে এসে মাথায় তার এখনো গেরস্তালির খোয়াব; সে নাকি একদিন না একদিন আক্কাসের ভিটিতে ঘর তুলে আশপাশে আনাজ-তরকারির আবাদ করবে। শুনে আক্কাস মনে মনে হেসেছে – ঘর, আবার আনাজ-তরকারি! এক টুকরা লম্বালম্বি জমি। খনকার যে সাধাসাধি করে, এর কারণ জমিটা লম্বাটে বলে তার বাড়ির সঙ্গে জুততে সুবিধা।

বউয়ের মন খারাপ দেখেও আক্কাস লম্বা কাহনে গেল না, এক কথায় যা বলল, একটা ব্যাটারি রিকশা যদি করতে পারে, অন্য কোনোখানে সুবিধামতো জায়গা দেখে ঘর বানাবে, আল্লা চাহে তো এই ঢাকা শহরেরই ধারেকাছে। কথার কথা ছাড়া কী!

রমিজা কী বুঝল না বুঝল সে-চিন্তায় না গিয়ে খনকারের কাছেই ভিটি বেচে আক্কাস এক তাড়া হাজার-পাঁচশোর নোট কোমরে কষে বেঁধে দুই রাত না ঘুমিয়ে পার করল। খনকার ঠকায়নি, প্রথমে চল্লিশ হাজার বলেছিল, পরে আক্কাসের চাপাচাপিতে আরো পাঁচ দিতে বড় একটা আপত্তি করেনি। পুরো পঞ্চাশ হলে আক্কাসের মন ভরত, তারপরও যা পেয়েছে ভালোই। সাবরেজিস্ট্রি অফিসে দৌড়াদৌড়ি, খতিয়ান-পরচা বের করা, বকেয়া খাজনা মেটানো সব খনকারই করেছে। কিন্তু টাকা যে আরো লাগবে, বাড়তি টাকার কী গতি করবে? নতুন কেনার প্রশ্ন ওঠে না, শুনেছে আশি-পঁচাশির কমে হয় না, বছর দুয়েক চলেছে এমন একটার দামও ষাটের ওপর। ধার-দেনা ছাড়া উপায় নাই। সপ্তাখানেকে ব্যবস্থা একটা হলো। ব্যাটারি রিকশার রোজগার ভালো, দিনে ষোলো-সতেরোশো, ধার যে দেবে সে জানে সুদসহ টাকা ফেরত পাওয়া কঠিন কাজ না। তার মহাজন জান্নাত হাজি খামোকা গাঁইগুঁই করে হাজারে তিনশো টাকা সুদে পঁচিশ হাজার ছাড়ল। আক্কাস মনে মনে বলল, শালা চশমখোর, তবে এ-ও মন্দের ভালো।

দিনে প্যাডেল মারার ফাঁকে আক্কাস এদিকে-ওদিকে ব্যাটারি রিকশার খোঁজখবর নেয়। নিজে কী বুঝতে কী বুুঝবে, তাই তার জানিদোস্ত গ্যারেজ মেকানিক কাজেমকে নিয়ে নানা জায়গায় ঘোরাঘুরি করে। কাজেম নানা খুঁত বের করে। এদিকে দেরি হচ্ছে দেখে চিন্তায় চিন্তায় আক্কাসের পা চলে না, প্যাডেল মারতে এত কষ্ট আগে কোনো দিন বোঝেনি।

শেষে কাজেমের পছন্দমতো একটা পাওয়া গেল। রঙচঙে নতুনের মতোই দেখতে, বড়সড় ঘটিমুখ লাইট, চওড়া টায়ার। বছর দেড়েক নাকি চলেছে, তবে দাম চাচ্ছে সত্তর। ষাট দিয়ে শুরু করে চৌষট্টিতে রফা হতে কাজেমকে আক্কাস মোরগপোলাও খাওয়াল।

ঘরে ফিরে রমিজাকে বলতে সে ভিটি বিক্রির দুঃখ ভুলে বলল, কই, দেখি গাড়ি। বছর সাতেকের মেয়ে বিউটিও বায়না ধরল গাড়ি দেখবে। দুজনের মুখে গাড়ি শুনে আক্কাসের বুকে যে আরামের হাওয়া খেলল, তার জবাব নাই। ব্যাটারি রিকশা যে রিকশা না, গাড়ি – এ-কথা তার মাথায় আসেনি। কাউকে বলতেও শোনেনি। বউ-মেয়েকে সে সবুর করতে বলল। গাড়ি যখন, এর তো খোরাক দরকার, ব্যাটারি চার্জ দেওয়া লাগবে। বুদ্ধিজীবী কবরস্থানের কাছে এক জায়গায় গাড়ি রেখে এসেছে, রাতভর ইলেকট্রিকের দম টানবে। এজন্য দেড়শো টাকা রোজ। দিনে দেড়শো শুনে রমিজা আল্লা গো বলতে যাবে, আক্কাস বলল, দিনে যুদি পনেরোশোও কামাই করি, দেড়শো দিতে কিয়ের চিন্তা! খরচাপাতি, খাওনদাওন বাদে দিনে হাজার টাকা জমব, মাসে কমের মধ্যে তিরিশ হাজার, গাড়ির দাম তুলতে তিন মাসও লাগব না।

রাতে খেতে বসতে যাবে, দুপুরে ঠেসে মোরগপোলাও খাওয়ায় খিদা তেমন ছিল না, কিন্তু রমিজা যে খিচুড়ি আর ভুনা গরুর মাংস রেঁধে বসে থাকবে, তার কল্পনায়ও ছিল না। রাতটা গেল মহাউত্তেজনায়, ভোর ভোর গাড়ি হাতে পাবে। তবে দুম করে রাস্তায় না নামিয়ে অন্তত দুই দিন খালি জায়গায় রয়েসয়ে চালিয়ে গাড়ির রকমসকম বুঝতে হবে। রাতটা আবার অন্য কারণেও মনে রাখার মতো। গাড়ি নতুন না হলে কী হবে, শুতে গিয়ে আট বছরের পুরনো রমিজাকে মনে হলো

আনকোরা-নতুন।

দিনকয়েক বাদে প্রথম যেদিন রাস্তায় নামল, আক্কাসের মনে হলো ব্যাটারি গাড়ি চালানোর সুখই আলাদা। পা জোড়ার তো এতদিন খাটনির শেষ ছিল না, কী কষ্টই না গেছে এদের, এখন কাজবাজ নাই, তারা আরাম করবে, আর ফোমের গদিতে বসে গাড়ি চালু করতে ভিতরে ভিতরে তার যে কী টগবগানি – যেন রাস্তা দিয়ে না, হাওয়ায় উড়ছে, জাদুগাড়ি। তবে প্যাসেঞ্জার নিয়ে বউনির আগে রমিজা আর বিউটিকে পেছনে বসিয়ে এক রাতে বিজয় সরণি আর সংসদ ভবনের চওড়া সড়কে কয়েক পাক দিয়ে নিজের সুখটা তার একার রাখেনি।

প্রথম-প্রথম প্যাসেঞ্জার নিয়ে সাবধানে চালালেও আক্কাসের বুঝতে বাকি থাকেনি চাইলে সে সিএনজি অটো, এমনকি চার চাকার ছোট গাড়ির সঙ্গে পাল্লা দিয়ে ছুটতে পারবে। আসল ব্যাপার যা – গতি যত বাড়ে তার ভিতরে একটা জেদ চাপে। কী সেটা ঠিক বুঝতে পারে না। আগে যখন প্যাডেল মেরে বুকে হাঁপ ধরিয়ে গলি-ঘুপচি বা বড় রাস্তায় নামত, সাবধানে থাকত, কে কোনদিক থেকে গুঁতো দেয়। ফাঁকা পেলে জোরে প্যাডেল মারত ঠিকই, তবে বেখেয়ালে উল্টোপাল্টা কিছু করলে গাড়িওয়ালারা তো বটেই, সিএনজি ড্রাইভাররাও তেড়েফুঁড়ে উঠত, এমনকি জাতভাই রিকশাওয়ালারাও বাদ যেত না, সঙ্গে খিস্তির র্ছরা। কিল-ঘুসিও জুটত। পাল্টাপাল্টি সে-ও কম যেত না, তবে বুঝত বাড়াবাড়ি করলে বিপদ।

দিন কি বদলে গেছে? প্রশ্নটা নিজেকে করে না আলী আক্কাস, তবে বোঝে তার নিজের মধ্যে কিছু একটা হচ্ছে।

হঠাৎ হঠাৎ একটা রোখ চাপে, যেন সামনে যা-কিছু – গাড়ি, মানুষ, রিকশা – সব তছনছ করে দেয়। এ কয়দিনে একটা বিষয় সে ভালোই বুঝেছে, হাইওয়েতে যে ট্রাকের ধাক্কায় রোজ অন্তত ডজনখানেক গাড়ি-টেম্পো-বাইক মিসমার হয়, মানুষ মারা পড়ে, এর পেছনে লাগসই কারণ রয়েছে। ট্রাক ড্রাইভার যখন স্টিয়ারিং পাকড়ে একমাথা উঁচুতে গদিনসিন হয়, সে কী তখন এলেবেলে কেউ থাকে! তার চোখে সামনে সবকিছুকে পোকামাকড়ের মতো লাগে, কাকে মারল কি পিষল – মানুষ না গাড়ি না জন্তু-জানোয়ার – মাথায় থাকে না।

এ না হয় গেল ট্রাকের কথা – রাস্তার রাজা, কিন্তু ব্যাটারি গাড়ি ছুটিয়ে তার মাথায় যে এমন চিন্তা আসে, এর কী কারণ? এদিকে প্যাডেল রিকশা দেখলে তার হাসি পায়, নিজে যখন চালাত, তখন নিশ্চয় ব্যাটারিওয়ালারা তাকে দেখে হাসত।

একদিন না চাইতেই একটা ঘটনা ঘটিয়ে ফেলল। পল্টন মোড় থেকে বিজয়নগর রোড ধরে পশ্চিমদিকের এক গলিতে ঢুকবে, পথ আগলে এক বুড়ো রিকশাওয়ালা। খালি রিকশা, তবু সিট থেকে নেমে টেনে সরাতে গিয়ে কী কাহিল দশা! আক্কাস একটু অপেক্ষা করল, বুড়ো তার চিমসানো কোমর টানটান করেও রিকশাকে ঠেলে সরাতে হিমশিম খাচ্ছিল। আক্কাস আর পারল না, ইচ্ছা করছিল সোজা নাক বরাবর ঠুসে দেয়, তা অবশ্য করল না, তবে পথ করে যেতে এক ঘসায় বুড়োসুদ্ধ রিকশাকে ড্রেনে ফেলে সে তার মতো ছুটল। মজার ব্যাপার, যে-প্যাসেঞ্জার দুজনকে নিয়ে যাচ্ছিল, তাদের হয়তো যাওয়ার তাড়া ছিল, আক্কাসের চটজলদি কাণ্ড দেখে সাবাসি দিয়ে বলল, ঠিক কাম করছ।

রাতে ঘটনাটা রমিজাকে বলতে সে আল্লা গো, এইডা তুমি করতে পারলা বলে চোখ সরু করে তাকে দেখল। একটু পরে যা বলল তা খানিকটা প্যাঁচালো। বলল, বুড়া রেশকাওলা পাইয়া কামডা করলা, যুদি ব্যাক পথ আগলাইয়া একখান টেরাক থাকত, কী করতা? টেরাক থোও, সিএনজি কি টেম্পো থাকত? গুঁতা মারলে নিজের গাড়িখানই গুঁড়াগুঁড়া অইত। কী করলা, আবার বুক ফুলাইয়া কইতে লাগছ!

আক্কাস কিছু বলল না, দিনের রুজি গোনাগুনতি সেরে প্রায় আঠারোশো টাকা রমিজার হাতে দিতে যাবে, সে চুলায় কী পুড়ছে বলে সামনে থেকে সরে গেল। আক্কাস খুব অবাক হলো।

রমিজা যা-ই বলুক, আক্কাসের হিসাব তার নিজের। বছর চারেক এমন রোজগার থাকলে … থাকলে কী – তার

মাথায় আসে না। জায়গা কিনবে, ভিটি বিক্রির সময় রমিজাকে যেমন বলেছিল? সে তো ছিল কথার কথা। অন্য কিছুতে মন দিতে পারে। মনে মনে বছর চারেকের রোজগারের একটা হিসাব করে সে ঘাবড়ে যায়, চাইলে কি একটা পুরনো আট সিটের মাইক্রো কিনতে পারবে না? রাস্তাই যখন তার রুটি-রুজির উপায়, রাস্তাতেই থাকবে – প্যাডেল ছেড়ে ব্যাটারি ধরেছে, আগামীতে আল্লা চাহে তো চার চাক্কা। ভাবতে ভয় ভয় লাগলেও কয়েকদিন মাথায় চার চাকার আনাগোনায় ভয়টা ঠিক ভয় থাকে না, তবে খোয়াব বললে ঠিক আছে, খোয়াব নিয়েই মানুষ বাঁচে।

কিন্তু রোখটাকে নিয়ে কী করে? এই যে রাস্তায় নামলেই সে চাক বা না চাক, গতি বাড়াতে হাত চিড়বিড় করে – কার ওপর খার মেটাতে? রাত বাড়লে ফাঁকা রাস্তায় রীতিমতো তুফান তুলে ছোটে। বেশি জোরে চালালে ব্যাটারির ক্ষতি কথাটা

সময়-সময় নিজেকে মনে করিয়েও কাজ হয় না। এমনও ভাবে, খোদা-না-খাস্তা, যদি অ্যাক্সিডেন্ট করে বসে। ট্রাক তো না যে টক্কর দিয়ে পার পেয়ে যাবে, বরং রমিজা যেমন বলেছিল গুঁড়াগুঁড়া হয়ে যাবে। ব্যাপার যেন এমন, তার করার কিছু নাই, প্যাসেঞ্জার থাকলে তো বটেই, খালি অবস্থায়ও যখন চাপে তার হুঁশজ্ঞান থাকে না, কে যেন মাথায় তাল ঠোকে – জোরে, জোরসে।

এ-অবস্থায় সংসারের চেহারার উন্নতি হওয়ারই কথা। আগের বস্তি ছেড়ে দুই কামরার ঘর নিয়েছে, সেটাও বস্তি, তবে আগেরটার চেয়ে সুবিধার। আক্কাসের মতে, আগের বস্তির বড় অসুবিধা ছিল আশেপাশে সব প্যাডেলওয়ালা। রমিজা এ যুক্তি শুনে বলেছে, নিজে এত বছর প্যাডেল মাইরা এখন জাতে উঠছ। আক্কাসের বেশবাস বদলেছে, প্যান্ট আগে পরেনি, এখন দেখল লুঙ্গির চেয়ে প্যান্ট পরে পা ছড়িয়ে বসতে সুবিধা। বিউটির গাঢ় নীলরঙা স্কুলড্রেস হয়েছে, আর যা না বললেই নয়, একদিন রমিজাকে তাক লাগিয়ে ঘরে একটা পুরনো ছোট ফ্রিজ ঢুকিয়ে বলেছে, গরমে ঠান্ডা পানির মতো কী আছে!

ফ্রিজ দেখে রমিজার চোখ কপালে উঠলেও খুশি যে হয়েছে তা বলতে হবে না। যত ছোট আর পুরনোই হোক, ফ্রিজ বলে কথা। ফ্রিজ দেখে বিউটির বায়না পুরনো একটা টিভিও যদি আক্কাস ঘরে ঢোকাত! আক্কাস শোনে, মনে মনে বলে, মানুষের চাওয়া-পাওয়ার হিসাব কেমন বদলায়। তার নিজের মাথায় যেমন একটা মাইক্রোর আওয়াজ যখন-তখন গজরায়।

জান্নাত হাজির ধার শোধ হয়েছে বেশ আগে। লোকটা ত্যাঁদড়, পাঁচ ওয়াক্ত জামাতে নামাজ পড়ে, সফেদ
পায়জামা-পাঞ্জাবি আর মাথায় সৌদির ছিদ্রওয়ালা গোলটুপিতে তাকে চেয়ারম্যান-মেম্বার বলে মানায়। কিন্তু মাথাভরা ত্যাঁদড়ামি বুদ্ধি। সুদে-আসলে টাকা পেয়ে তেরচা চোখে আক্কাসকে খুঁটিয়ে দেখে বলল, আইজকাইল তাইলে
লুঙ্গি-গামছা বাদ দিয়া প্যান্ট-শার্ট ধরছস। ঘরেও কি এইগুলা পিন্দা থাকস? ব্যাটারির ফুটানিতে জাতে উইঠা রেশকাওলা নাম খারিজ করবি!

জান্নাত হাজির ধাত এমনই। কয়েক বছর আক্কাস তার রিকশা চালিয়েছে, সেই জোরেই যা-খুশি বলেছে। তার এখনকার বেশভুষায় জান্নাত হাজির গায়ে জ্বালা ধরলে কী করার আছে! আসল কথা, লুঙ্গি-গামছা নিয়ে তো ব্যাটারি গাড়ির সিটে বসতে অসুবিধা, আর গুলিস্তান বা পল্টনের ফুটপাতে গার্মেন্টের প্যান্ট যে লুঙ্গির থেকে সস্তা, এ-কথা জান্নাত হাজি না-ও জানতে পারে।

অনেকদিন পরে কাজেমের খোঁজে তার গ্যারেজে এসে মনটা খারাপ হলো। দশ-বারো বছর গ্যারেজে কাজ করলেও কাজেম এখনো মূল মেকানিকের জোগালি। কালি-ঝুলি মাখা জামা-কাপড়ে একটা পিকআপের তলা থেকে গা ছেঁচড়ে বের হয়ে আক্কাসকে দেখে কিছুটা যেন অবাক হলো। আক্কাসের পরনে জিনসের টাইট প্যান্ট আর টুকটুকা লাল টি-শার্ট। বন্ধুকে খাতির করে আক্কাস একটা টঙের দোকানে গিয়ে চায়ের সঙ্গে অমলেট-বনরুটির অর্ডার দিলো। ময়লা হাত না ধুয়েই কাজেম চায়ে চুবিয়ে বনরুটিতে কামড় দিলো। আক্কাসের মনে হলো, কাজেম তার কাজ ভালো জানে, চাইলে কি নিজেই ধার-দেনায় একটা ছোটখাটো গ্যারেজ করতে পারে না? এত বছর লেগে আছে, রুজি-রোজগার খারাপ হওয়ার কথা না। বেতন ছাড়া বখশিশও নিশ্চয় পায়। কাজেমকে আক্কাস তার দিনবদলের কথা শোনালো, এ-ও বলল ব্যাটারি গাড়ি আরো আগেই তার করা উচিত ছিল। কাজেম মুখ তুলে তাকে দেখে মুচকি হেসে বলল, ব্যাটারি গাড়ি। ভালোই, তুই গাড়ির মালিক আর আমি মেকানিকের জোগালি।

কাজ পড়ে আছে বলে কাজেম উঠে পড়তে আক্কাস ভাবল কাজেমও কি তাকে হিংসা করতে শুরু করল! তাকে গাড়ির মালিক বলল। গাড়ি কথাটা তো তার না, বউ-মেয়ের মুখেই প্রথম শুনেছে, এখন নিজেকে নিজে শোনায়। কাজেম বন্ধু মানুষ, না হয় মুখ ফসকে বলে ফেলেছে, তাতে দোষের কী! ভাগ্যিস, কাজেমকে সে মনের কথাটা বলার সময় পায়নি, মাইক্রোর কথা তার কানে গেলে কী বলত কে জানে!

তার অবস্থা বদলাচ্ছে, নিজের চেষ্টা ও বুদ্ধিতে বদলাচ্ছে, এতে দোষ কোথায়! কিছু করার নাই, সে তার মতো চলবে, কারো ধার ধারবে না। আর এতে, জান্নাত হাজি যা-ই বলুক, রিকশাওয়ালা নামটাও খারিজ হবে। শোনা কথা, জান্নাত হাজি একসময় রিকশা চালাত, সত্যি না মিথ্যা বলতে পারবে না, একবার নাকি এক প্যাসেঞ্জারের ফেলে যাওয়া ব্যাগে কয়েক বান্ডিল টাকা পেয়ে সে মাসখানেক গা-ঢাকা দিয়েছিল, ফিরে এসে জায়গা বদলে রিকশার গ্যারেজ করেছিল। তখন সস্তাগণ্ডার আমল, শুরুই নাকি করেছিল দশ-বারোটা রিকশা দিয়ে। এখন তো শুধু রিকশা না, তার কত ব্যবসা কে বলতে পারে!

টাকা-পয়সার যে হিসাবটা আক্কাস মনে মনে করে রেখেছিল তাতে কিছু হেরফের হয়েছে, গাড়ির ব্যাটারি মোটামুটি ঠিক

থাকলেও টুকটাক মেরামতিতে প্রায় মাসেই কিছু না কিছু বাড়তি খরচ হয়। সামনে একটা বড় ধাক্কা আসবে, কন্ট্রোল বক্সে কিছু একটা গড়বড় দেখা দিয়েছে. হঠাৎ হঠাৎ স্টার্ট বন্ধ হয়ে যায়, নতুন টায়ারও একটা লাগবে। তারপরও টাকা তার ঠিকই জমছে। মাইক্রোর চিন্তাটা এখন আর খোয়াব মনে হয় না।

সেদিন খেপ দিতে বেশ দূরে রওনা দিতে হয়েছিল, অনেকটা ইচ্ছার বিরুদ্ধে। রোকেয়া সরণি থেকে দুজন
মহিলা-পুরুষ, খুবসম্ভব স্বামী-স্ত্রী, যাবে দিয়াবাড়ি পার হয়ে সেই বিরুলিয়ায়। সময় তখন দুপুর, আকাশে মেঘ, বৃষ্টি নামতে পারে। আক্কাস ভাবছিল ঘরে গিয়ে ভরপেট খেয়ে টানা ঘুম দেবে। দূরের পথ, একবার ওমুখো গেলে ফিরতি খেপ এদিকে পাবে কি না কে জানে! শরীরটাও ম্যাজমেজ করছে। যাবে কি যাবে না ভাবছিল। তার হাবভাবে স্বামী-স্ত্রী ভাবল বেশি ভাড়ার লোভ দেখালে কাজ হবে। তিনশো বলে স্বামীটা এক লাফে চারশোতে পৌঁছে আক্কাসের দিকে তাকাল। আক্কাস ভাবল, এরা হয়তো মেঘলা দিনে আরামে বাতাস খাবে বলে তাকে সাধাসাধি করছে, বেশি ভাড়ার কথা বলছে। কী আর করে, সাধা লক্ষ্মী পায়ে ঠেলতে নাই, আক্কাস দোনোমনা ছেড়ে রাজি হলো।

গাড়িতে উঠেই স্বামী লোকটা গল্প জুড়ে দিলো – বাড়ি কোথায়, সংসারে কে কে আছে, ঢাকায় কোথায় থাকে, ঘরভাড়া কত, হেনতেন। খারাপ লাগছিল না, প্রথম থেকেই লোকটা আপনি আপনি করে বলছিল। মহিলা মনে হয় ঢাকায় নতুন, ব্যাটরি গাড়িও হয়তো চড়েনি, ঠান্ডা হাওয়ায় মজা পাচ্ছিল, আর একটু পরপর ড্রাইভারভাই ড্রাইভারভাই বলে এটা কী ওটা কী জানতে চাচ্ছিল। এয়ারপোর্ট রোড ছেড়ে দিয়াবাড়ির দিকে যেতে রাস্তা ফাঁকা পেয়ে আক্কাস জোর বাড়াল। তার কানে এলো লোকটা তার স্ত্রীকে বলছে, মনে হচ্ছে খোলা জিপ চড়ছি। কথাটায় আক্কাস রীতিমতো ঝাঁকি খেল, জিপ সে কোনোদিন চড়েনি, খোলা জিপ দূরের। এমন কথা অন্য কেউ না, খোদ প্যাসেঞ্জার বলছে ভাবতে সে আনমনা হয়ে পড়ল। বেখেয়ালে যে রাস্তার মাঝবরাবর চলছে মাথায় আসেনি, পেছনে একটা গাড়ির হর্ন শুনেও সে পাত্তা না দিয়ে এগোতে থাকল। গাড়িটা নাছোড়, হর্ন দিয়েই যাচ্ছে, এদিকে আক্কাসের মাথায় রোখ, যেন তাকত থাকে তো তার মাথার ওপর দিয়ে যাক। পেছনের গাড়ির ড্রাইভার হর্ন টেপা ছেড়ে মজা করেই যেন একটা গুঁতো দিলো, গুঁতো না বলে টোকা বলাই মানায়। যা হওয়ার হলো, আক্কাসের গাড়ি ছিটকে একটা ঝরঝরে মিনিবাসের গায়ে ঠোকর খেয়ে উল্টে গেল। কিছু বোঝার আগেই সে লাট্টু পাকিয়ে গিয়ে পড়ল হাতদশেক দূরে।

কতক্ষণে হুঁঁশ ফিরেছে বলতে পারবে না। চোখ খুলতে দেখল তাকে ঘিরে জনাপাঁচেক লোক, একজন ভেজা গামছা চিপে মাথায় পানি দিচ্ছে। তাকে তাকাতে দেখে চউখ মেলছে, চউখ মেলছে বলে সে অন্যদের বলল। আক্কাস মনে করতে চাইল কী ঘটেছে। ছেঁড়াছেঁড়া মনে পড়ল। উঠে বসতে যাবে, যে লোকটা পানি দিচ্ছিল, বলল, আজিব মানুষ তো, গাড়ির লগে রেশকার রেইস লাগাও! বলে সে অল্প দূরে হাত ইশারা করতে আক্কাস দেখল রাস্তার কিনারে সামনের চাকাসহ আধাআধি আলগা হয়ে পড়ে আছে তার ব্যাটারি গাড়ি। আর এট্টু হইলে তুমারে সুদ্ধা গুঁড়াগুঁড়া হইত, বলল আধবুড়ো লোকটা। রমিজার কথা, বললও যেন রমিজার বলার কায়দায়। প্যাসেঞ্জার দুজনের কথা মাথায় এলো আক্কাসের। জিগ্যেস করতে লোকটা জানাল তেমন কিছু হয়নি, একটা সিএনজি ধরে তারা চলে গেছে। যাওয়ার আগে তার পকেটে পাঁচশো টাকার নোট গুঁজে দিয়ে গেছে।

কোনোমতে উঠে দাঁড়িয়ে হাত-পা ঝেড়ে আক্কাস বুঝল ভাঙাভাঙির মতো কিছু হয়নি, তবে ব্যথা সারা গায়ে, বিশেষ করে ঘাড়ে-কোমরে, আর কনুই-হাঁটু ছড়ে গিয়ে জ্বালাপোড়ার একশেষ। পরনের জামাটার বুক-পিঠ ছিঁড়ে ফালাফালা, কিছুতে টান খেয়ে এ-অবস্থা। তাকে উঠে দাঁড়াতে দেখে বাকি লোকগুলো আরো কাছে ভিড়ল। রাস্তা লাগোয়া কয়েকটা খালি রিকশা দেখে বুঝতে বাকি থাকল না এগুলো এদেরই, সবাই প্যাডেলওয়ালা। গায়ে
ব্যথা-যন্ত্রণা বাড়ছে, দাঁড়িয়ে থাকতে না পেরে সে বসে পড়ল, মাথাও ঘুরছে, ইচ্ছা হলো শুয়ে পড়ে। সে শুয়েই পড়ল। এর মধ্যে একজন তার ছেঁড়া শার্ট খুলে খালি গায়ে একটা গামছা জড়িয়ে জানতে চাইল কোথায় থাকে। গলা দিয়ে কথা বেরোলো না। পানির জন্য গলা কাঠকাঠ, ওদের একজন পানি খাওয়াল। ভাঙা গাড়ির জন্য ওদের গলায় আফসোস – রেশকাডার কী অবস্থা! গাড়ির লগে টক্কর দিতে গেছিল কোন আক্কেলে! অবস্থা তো সুবিধার না, ডাক্তারখানায় নেওয়া লাগব।

লোকগুলের কথাবার্তায় মশকরা নেই। মাথায় যন্ত্রণা বাড়ছে। এতক্ষণে মনে হচ্ছে ঘাড়-মাথার একটা-দুটো রগ ছিঁড়ে গেছে। আকাশে আলো কমে আসছে, ঠান্ডা বাতাস বইছে, গায়ে জড়ানো গামছায় আরাম লাগছে।

চিৎ হয়ে শুয়ে আলী আক্কাস ঘোরঘোর চোখ দুটো এই খোলে, এই বন্ধ করে। বন্ধ অবস্থায় দেখে সে তুফান বেগে ছুটছে, আওয়াজটা অন্য রকম – মাইক্রোর, আর খোলামাত্র ধন্দে পড়ে, গোল হয়ে বসা এরা কারা?


আরও