সন্ধেবেলা বর্ষাকালের সাইকেল নিয়ে ক্যাঁচ কুঁচ করতে করতে বাড়ি থেকে বেরলেন মাস্টারমশাই। একটু এগোতেই একঘেঁয়ে নিম্নচাপ আবার শুরু করল ফিসফিসানি, অগত্যা ছাতা খুলতে হলো। বাজার পেরিয়ে বড়ো রাস্তাটা ক্রস করতেই এবার চুপ করে গেলো বৃষ্টি। শুরু হলো অলিগলি আর লোডশেডিং। এতক্ষণ খেয়াল করেননি, এবার দেখলেন শ্রাবণের মেঘময় আকাশেও পূর্ণিমার গোল চাঁদ ফুরফুরে আলো দিচ্ছে, অন্ধকার সেভাবে নেই, জলকাদার ভাঙা পিচের রাস্তা দিব্যি দর্শণ ইন্দ্রিয়ের গোচরে। মাস্টারমশাইয়ের পা দুটো প্যাডেলে ঘুরছে, হাত দুটো পোক্ত হাতে নিয়ন্ত্রণ করছে হ্যান্ডেল, দক্ষিণপন্থী হাতটা আবার প্রয়োজনে বেল বাজাচ্ছে আর চোখ দুটো আকাশে। চাঁদের আলোর হলুদ ছাইয়ে মিশে গেলো মাস্টারমশাইয়ের খোঁচাখোঁচা দাড়ির মুখমণ্ডল; আকাশের নীল আর তার জামার নীলে সামান্য ফারাক একই আকাশের নীচে অনেক রাস্তার মোড় ঘুরিয়ে দিচ্ছে, আর মাস্টারমশাই চলেছেন… ওই নারকেল গাছের মাথায় ঢেকে গেলো খানিক, একবার রাস্তায় একবার মেঘে সাইকেল চালাচ্ছেন মাস্টারমশাই পুরনো গলি দিয়ে, যেটা মিশেছে এসে চার-মাথার একটা মোড়ে, সেখানে আসতেই তিন দিক থেকে তিনটে জোড়ালো চাঁদের মতো আলো হর্ন দিতে দিতে যে যার দিকে বেরিয়ে গেলো; নির্বিকার মাস্টারমশাই ওই তিনজনের ফাঁক দিয়ে কোনো একটা রাস্তায় ঢুকে পড়েছেন। কী একটা হতে গিয়ে হলো না বুঝে একটা লোমওঠা নেড়িকুত্তা দু-চারবার ঘেউ ঘেউ করে থেমে গেলো যথাস্থানে। কিন্তু আজ আর পড়াতে যাওয়া হলো না, তবু কোথায় যেন যাচ্ছেন মাস্টারমশাই। ছাত্রীর বাড়ির হ্যারিকেনের হলুদ আলো মনে পড়ছে, দশ টাকার হলুদ ডুম রাস্তার লাইনে হূক মেরে কাদের যেন মাটির ঘরে জ্বলতো-কাদের যেন! কাদের যেন! — আঃ মনে পড়ছে না, আর কিচ্ছু মনে পড়ছে না, দরদর করে ঘামছেন মাস্টারমশাই। এই নিম্নচাপ সমতলের বায়ুকে একটুও উষ্ণতাহীন করতে পারেনি, ধরে রেখেছে আষ্টেপৃষ্ঠে, চাঁদের আলোর হলুদ মেঘ, মাস্টারমশাইয়ের রাস্তা —- পেরিয়ে চলেছে কাঁঠালতলার গলি, বায়ে রইলো জলেশ্বর মন্দির, আরও কিছুটা গিয়ে ডানদিকে বঙ্গীয় পুরাণ পরিষদ, আরো পরে চাঁদসী ডাক্তারখানা ডানে রেখে তোপখানা মসজিদ ছুঁয়ে বেরিয়ে গেলো সোজা নতুনহাটের দিকে; মাস্টারমশাই চলেছেন, সাধারণ চুলের টবমুখো মাথাটা পেছনে ফিরিয়ে দেখলেন চাঁদও আসছে পিছু পিছু… সাইকেলের চাকা দুটো বাজারের প্যাঁচপ্যাঁচে কাদা ডিঙিয়ে ক্যাঁচক্যাঁচ করতে করতে মাস্টারমশাইকে নিয়ে বাড়ি ফিরছে, বাড়ি ফিরছেন, পিছনে পিছনে চাঁদ। কত রাত বোঝা যাচ্ছে না, তবে চারদিক বেশ নিস্তব্ধ। আকাশে চাঁদের শ্যাম্পু করা হলুদ চুলের থেকে একটু দূরে একটা তারা দ্যাখা যাচ্ছে-সন্ধ্যাতারা নাকি শুকতারা! চাঁদেরও খেয়াল নেই, সে চলেছে মাস্টারমশাইকে অনুসরণ। মাস্টারমশাইয়ের বাড়িতেও আকাশ আছে, মেঘ আছে, তার ঘরের পাশেই আছে এক মস্ত নারকেল গাছ।