শনিবার , ২১শে ডিসেম্বর, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ

অনুবাদ

এলহাম হোসেনের অনূদিত গল্প সীমানা

প্রতি শনিবার একটা না একটা নতুন পরিবার ছুটি কাটাতে আসে। কেউ আসে বেশ সকালবেলা। ঐ দূর থেকে, এরা আয়েশ করতে আসে। কেউ আবার সূর্যাস্তের আগে আসে না। একেবারে রেগে মেগে আসে। পথ হারিয়ে হন্যে হয়ে খুঁজতে খুঁজতে। পাহাড়গুলোর মধ্যে পথ হারিয়ে ফেলা সহজ। রাস্তাগুলোতে ঠিকানা-নির্দেশক নেই বললেই চলে।
আজকে ওরা ওঠার পর আমি ওদের ঘুরে ঘুরে জায়গাটা দেখালাম। মা সাধারণত ওদের অভ্যর্থনা জানানোর কাজটা করে থাকে। তবে এখন সে গ্রীষ্ম কাটাতে গেছে পাশের শহরে। এক জ্যেষ্ঠ ব্যক্তিকে তার অবকাশ উদযাপনে সাহায্য করতে। কাজেই, তার কাজ এখন আমাকেই করতে হচ্ছে। অন্য সবার মতই ওরা চারজন- মা, বাবা আর দুই মেয়ে। ওরা আমার পেছন পেছন আসে। আনন্দ আর বিস্ময়ে চোখগুলো ওদের বড় বড় হয়ে গেছে। উত্তেজনায় পা চলছে দ্রুত। এক মুহূর্তের জন্য আমরা বাড়ির আঙিনায় একটি ছায়াবৃত স্থানে দাঁড়ালাম। লন দেখা যায় ওখান থেকে। ওখানে একটা চালা আছে সূর্যের তাপ আটকানোর জন্য। ওখানে দু’টি আর্ম চেয়ার আর একটা সোফা রাখা হয়েছে। সাদা কাপড়ে ঢাকা। রোদ পোহানোর জন্য অবশ্য ওখানে চেয়ারও রাখা আছে। বড় একটা কাঠের টেবিল রয়েছে মাঝখানে। দশজন লোক একসঙ্গে বসা যায়।
কাঁচের স্লাইডিং দরজা খুলি। তারপর ওদের সবাইকে ভেতরটা ঘুরে ঘুরে দেখাই। ঘরটা পরিপাটিভ, সাজানো। ফায়ারপ্লেসের সামনে দু’টি আরামদায়ক সোফা রয়েছে। রান্নাঘরও প্রয়োজনীয় জিনিসে একেবারে ঠাসা।
ওদের বাবা যখন গাড়ি থেকে মালপত্র নামাতে ব্যস্ত তখন সাত ও নয় বছর বয়সী মেয়ে দু’টি ঘরের মধ্যে আত্মহারা হয়ে গেল। তারপর পেছন থেকে দরজা লাগিয়ে দিল। অতিরিক্ত তোয়ালে কোথায় পাওয়া যাবে সে কথা ওদের মাকে বললাম। রাতে শীত পড়লে পশমের কম্বল কোথায় পাবেন, সেটাও বলে দিলাম।
ইঁদুর মারার বিষ কোথায় লুকিয়ে রাখা হয়েছে, সেটিও দেখিয়ে দিলাম। ঘুমাতে যাওয়ার পূর্বে মাছি মারার কথা বলে দিলাম। বললাম, তা না হলে কিন্তু সকাল হতে না হতেই ওরা ভোঁ ভোঁ করতে শুরু করে দেবে। বিরক্ত করবে। এখান থেকে কিভাবে সুপার মার্কেটে যাওয়া যাবে, কিভাবে বাসার পেছনে রাখা ওয়াশিং মেশিন ব্যবহার করা যাবে, কাপড়-চোপড় কোথায় ঝুলিয়ে রাখতে পারবেন ইত্যাদি ব্যাপারে জানিয়ে দিলাম। এগুলো সব ঠিক আমার বাবা যে বাগানটা দেখাশুনা করেন, তার একেবারে ওপারে। লেটুস পাতা ও টমেটো যেকোন অতিথি ক্ষেত থেকে তুলতে পারেন। এবার ক্ষেতে প্রচুর টমেটো হয়েছিল। কিন্তু জুলাই মাসের বৃষ্টিতে সেগুলোর বেশিরভাগই পঁচে গেছে।

বিচক্ষণতার সঙ্গে ভান করলাম যে, আমি ওদের দেখিই নি। বাড়ির কাজ করি, বাগানের গাছগুলোতে পানি দেই। তবে ওরা যে কতটা খুশি ও উত্তেজিত, তা না দেখে পারি না। মেয়েরা লনে ছোটাছুটি করে, হৈ চৈ করে- সেটিও আমার কানে আসে। আমি ওদের নাম জেনে নিই। যেহেতু অতিথিরা আসবে তাই গেইট খুলে রাখে, তাই ওদের বাপ-মা স্যুটকেস খুলতে খুলতে কী গল্প করে, দুপুরে কি কি খাবে ইত্যাদি নিয়ে গল্প আমার কানে আসে।
যে কটেজে আমাদের পরিবার থাকে সেটি এখান থেকে মাত্র কয়েক গজ দূরে। একটা উঁচু ঝোপের ওপাড়ে। এটি বাড়িটাকে আড়াল করে রেখেছে। কয়েক বছর ধরে আমাদের বাড়ি বলতে ছিল একটি মাত্র ঘর। এর মধ্যেই রান্নার জায়গা। আমাদের তিন জনের শোবার ঘর এটি। তারপর বছর দু’য়েক আগে যখন আমার বয়স হলো তের বছর, তখন আমার মা জ্যেষ্ঠ লোকদের জন্য কাজ করতে শুরু করলো। বেশকিছু টাকা জমানোর পর আমার বাবা-মা সম্পত্তির মালিককে বলল, তারা আমার জন্য ছোট একটা ঘর বানিয়ে নিতে পারবে কি না। ঐ যে ওখানটাই যেখানে ছাদ আর দেয়ালের সংযোগ স্থলে ফাকা স্থানের মধ্য দিয়ে মোটাতাজা টিকিটিকিও ঢুকে পরতে পারে।
বাবা কেয়ারটেকার। এই বিশাল বাড়ি সে দেখাশুনা করে। কাঠ কাটেন। ক্ষেতে এবং আঙুরের বাগানে কাজ করে। বাড়ির মালিক যে ঘোড়াগুলোকে মনের সব আবেগ উজার করে দিয়ে ভালোবাসেন, সেই ঘোড়াগুলারও খোঁজ নেয় আমার বাবা।
বাড়ির মালিক বিদেশে থাকেন। তবে তিনি আমাদের মতো ভীনদেশী নন। তিনি প্রায়ই আসেন। স্বেচ্ছায়। তাঁর কোন সংসার নেই। দিনের বেলা ঘোড়ায় চড়ে বেরিয়ে পড়েন। সন্ধ্যায় ফায়ারপ্লেসের সামনে বসে বই পড়েন। তারপর আবার চলে যান।
গ্রীষ্মকাল ছাড়া অন্য কোন সময় তাঁর বাড়ি তেমন ভাড়া হয় না। এখানে প্রচন্ড শীত পড়ে। আর বসন্তকালে প্রচুর বৃষ্টি হয়। সেপ্টেম্বর থেকে জুন পর্যন্ত বাবা আমাকে প্রতিদিন সকালে স্কুলে নিয়ে যান। আমি সহজে অন্যদের সঙ্গে মিশি না। অন্য কারো মতোও দেখতে নই আমি। স্কুল আমার জায়গা নয় বলে মনে হয়।
এই পরিবারের দুই মেয়ে দেখতে প্রায় একই রকম। ওদের দেখেই আপনি বলে দিতে পারবেন যে, ওরা দুই বোন। একই রকম পোশাক পরে সমূদ্র সৈকতে যায়। সমূদ্র সৈকত এখান থেকে প্রায় পনের মাইল দূরে। ওদের মাকে দেখতেও মেয়েদের মতই। তিনি ছোটখাটো লিকলিকে মহিলা। লম্বা চুলের উইগ পরেন। কাঁধ দু’টো সুঢৌল। ঘাসের উপর খালি পায়ে হাঁটেন। বাবা মানা করা সত্বের। বাবা বলেন, ওখানে সজারু, ভীমরুল বা সাপ থাকতে পারে।

মাত্র কয়েক ঘন্টা বাদে মনে হলো যেন তারা এখানকার স্থায়ী বাসিন্দা। সাথে করে ওরা যে জিনিসগুলো এনেছে মাত্র এক সপ্তাহের জন্য তা সবখানে ছড়িয়ে ছিটিয়ে রাখলো। বই, ম্যাগাজিন, ল্যাপটপ কম্পিউটার, পুতুল, হুডি, রং পেন্সিল, পেপার-প্যাড, জুতা, সানস্ক্রীন। প্রতিদিন মধ্যাহ্নভোজের সময় একটা করে গ্লাস টেবিল থেকে ফেলে দেয় আর ভাঙ্গে। ওরা আস্তে আস্তে যে গল্পগুলো করে, তারও সূত্র আমি ধরতে পারি। কফি থেকে শুরু করে সিগারেট- সবকিছুরই গন্ধ পাই।
মধ্যাহ্নভোজের পর বাবা মেয়েদের একজনকে চশমা আনতে বলেন। অনেকদিন ধরে তিনি একটি রোডম্যাপ নিয়ে পড়াশুনা করছেন। ছোট ছোট শহরের তালিকা তৈরির কাজ করছেন তিনি। সেখানকার প্রত্নতাত্ত্বিক স্থান ও ধ্বংসাবশেষের তালিকা তৈরি করেন। মা’র আবার এসব কিছুতে আগ্রহ নেই। তিনি বলেন, বছরের এই একটি সপ্তাহে তাঁর জরুরি কোন অ্যায়য়েন্টমেন্টও নেই, দায়িত্ব নেই।
এরপর বাবা মেয়েদের নিয়ে সমূদ্র সৈকতে চলে গেলেন। রওনা দেওয়ার সময় আমার কাছে জানতে চাইলেন, সৈকতে পৌঁছতে কতক্ষণ লাগবে এবং সৈকতের কোন অংশটা সবচেয়ে সুন্দর। আগামী এক সপ্তাহের আবহাওয়ার পূর্বাভাসও জানতে চাইলেন। বললাম, সামনে একটা তাপদাহ আসছে।
ওদের মা বাড়িতে রয়ে গেলেন। গোসলের বিশেষ পোশাক পরে রোদে বসলেন। বারান্দার একটা চেয়ারে গা এলিয়ে দিলেন। মনে হলো, একটু ঘুমিয়ে নেবেন। কিন্তু আঙিনায় কাপড় শুকাতে দিতে গিয়ে দেখলাম তিনি কী যেন লিখছেন।
মাঝে মাঝে চোখ তুলে চারপাশের পরিবেশটা দেখে নেন। গভীরভাবে। বনের সব সবুজ গাছগুলোর দিকে তাকিয়ে থাকেন। দূরের পাহাড়, বনের দিকে নিবিষ্ট মনে চেয়ে থাকেন। জালজাল করে তাকিয়ে থাকা আকাশ আর হলুদ খড়বিচালির দিকেও চেয়ে থাকেন। চকচকে বেড়া, আর সীমানা-নির্ধারণী পাথরের তৈরি খাটো দেয়ালও তার দৃষ্টি এড়ায় না। যে জিনিসগুলো আমি প্রত্যেকদিন দেখি তিনি সেগুলোর দিকে চেয়ে থাকেন। তবে তিনি আসলে কী দেখেন- তা ভেবে ভেবে আমি বিস্মিত হয়ে যাই।

সূর্য পাটে নামতে শুরু করলে মশার হাত থেকে নিজেদের রক্ষার্থে ওরা সোয়েটার ও লম্বা প্যান্ট পরে নেয়। সৈকতের গরম জলে গোসল সেরে মেয়েরা ভেজা চুলে ওদের বাবার সঙ্গে ফিরে আসে। মেয়েরা বেড়ানোর পরিকল্পনা নিয়ে ওদের মা’র সঙ্গে গল্প করে। গনগনে গরমে পুড়তে থাকা সৈকতের বালি, কিছুটা ঘোলা জল, মৃদু ও হতাশ করার মতো সমূদ্রের তরঙ্গের বিষয়ে ওরা ওদের মা’র সঙ্গে গল্প করে। পুরো পরিবার একটু বেড়াতে বের হয়। ঘোড়া, গাধা, বুনো শুকর- যেগুলো আস্তাবলের পেছনের দিকে রাখা হতো সেগুলো ওরা দেখতে যায়। যে ভেড়ার পাল এসময় বাড়ির সামনে দিয়ে যাতায়াত করে সেগুলোও ওরা দেখে। এই ভেড়ার পাল এসময় ধূলধুসরিত রাস্তায় গাড়ির জটলা পাকিয়ে দেয় কয়েক মিনিটের জন্য।
ওদের বাবা মোবাইল ফোনে ছবি তুলতে থাকেন। তিনি মেয়েদের ছোট ছোট কুলগাছ, ডুমুর গাছ ও জলপাই গাছ দেখান। বলেন, গাছপাকা ফলের আলাদা একটা ঘ্রাণ আছে। এর স্বাদ সূর্যের মতই, একেবারে সোঁদা মাটির ঘ্রাণ।
বারান্দায় বসে বাবা-মা মদের বোতল খোলেন। স্থানীয়ভাবে তৈরি করা চিজ, মধু চেখে দেখেন। জালজালে উজ্জ্বল ভূপ্রকৃতির প্রশংসা করেন। বিস্তৃত উজ্জ্বল মেঘ, অক্টোবরের ডালিমের রং-এর প্রশংসা করেন।
সন্ধ্যা নেমে আসে। ব্যাঙের ঘ্যাঙর ঘ্যাং ডাক কানে আসে। ঝিঁ ঝিঁ পোকার ঝিঁ ঝিঁ শব্দ, শনশন করে বইতে থাকা বাতাসের শব্দ ওদের কানে দোলা দেয়। বাতাস বইতে থাকা সত্তে¡ও ওরা বাইরে বসে খাবার খেয়ে নেওয়ার পরিকল্পনা করে। এখনও বাইরে যেটুকু আলো বিদ্যমান রয়েছে, তা পুরোপুরি কাজে লাগাতে চায়।
আমি আর আমার বাবা ঘরের ভেতরে বসে নীরবে আমাদের খাবার খেয়ে নিলাম। খাওয়ার সময় বাবা অবশ্য মুখ তুলে তাকান না। মা বাসায় নেই বলে খাওয়ার সময় কোন গল্প হয় না। একমাত্র মা খাওয়ার সময় গল্প করে।
মা এই শহরে, এই স্থানে থিতু হতে পারে না। বাবার মত মা-ও অনেক দূর থেকে এখানে এসেছে। তবে নিশ্চয় ছুটি কাটাতে নয়। গ্রামে থাকাটাকে সে ঘৃণা করে। আসলে কোন স্থানেই না। সে মনে করে, এখানকার লোকজন ভালো নয়, এরা অসামাজিক।
আমি অবশ্য তার এই অভিযোগ করার বিষয় ধরতে পারি।
তার কথা শুনতে আমার ভাল্লাগে না। হক কথা বললেও মাঝে মাঝে যখন সে অযথা বক বক করতে থাকে, তখন বাবা তার সঙ্গে একই বিছানায় না ঘুমিয়ে গাড়িতে শুয়ে ঘুমায়। রাতের খাবার শেষে মেয়েরা জোনাকী পোকার পেছনে ছুটতে শুরু করে। জোনাকীর আলো নিয়ে খেলে। ওদের বাবা-মা বারান্দায় বসে তারাখচিত আকাশ দেখে। ঘন অন্ধকার ভেদ করে ওদের দৃষ্টি চলে যায় তারার দিকে।
মা লেবুযুক্ত গরম পানির কাপে চুমুক বসান। বাবা গ্রাপ্পার গ্লাসে চুমুক দেন। বলেন, এখানে বেড়াতে আসা তাঁদের দরকার ছিল। এখানকার বাতাস পর্যন্ত আলাদা। সবার কাছ থেকে দূরে একসঙ্গে থাকতে কী যে মজা!
সকালে আমার প্রথম কাজ হলো মুরগীর খাঁচা থেকে ডিম সংগ্রহ করা। ডিমগুলো উষ্ণ, ফ্যাকাশে ও নোংরা। কয়েকটা ডিম বাটিতে করে অতিথিদের নাস্তার জন্য নিয়ে আসি। সাধারণত আশেপাশে কেউ নেই। তাই বারান্দায় টেবিলে ডিমগুলো রেখে চলে যাই। এরপর দরজা ভেদ করে দেখি, মেয়েরা ইতিমধ্যে ঘুম থেকে উঠে পড়েছে। সোফায় বিস্কিটের ব্যাগ, ছোট ছোট রুটির টুকরো আর শস্যের কৌটো উপুর হয়ে পড়ে রয়েছে।
যে মাছিগুলো সকাল হতে না হতেই ভোঁ ভোঁ করতে শুরু করে দিয়েছে, মেয়ে দুটি সেগুলো তাড়াতে ব্যস্ত হয়ে পড়েছে। বড় মেয়ে মাছি তাড়ানোর র‌্যাকেট হাতে নিয়ে প্রস্তুত। ছোট বোনটা আবার হতাশ। বলে, সে তার পালা আসার অপেক্ষায় আছে। বলে, সে মাছি তাড়াতে চায়।
ডিমগুলো রেখে বাসায় চলে যাই। তারপর দরজার কড়া নাড়ি। আমাদের মাছি তাড়ানোর র‌্যাকেটটা মেয়েদের ধার দিই। এবার দুজনেই খুব খুশি হয়। ওদের মনে করিয়ে দিই না যে, ঘুমাতে যাওয়ার পূর্বে মাছি তাড়ানো ভালো। মাছি তাড়াতে মেয়েরা মজা পায়। অথচ মাছির বিরক্তি আর মেয়েদের হাতে র‌্যাকেট সত্ত্বে ওদের বাবা-মা ঘুমোচ্ছিল।

দু’দিন পর একটা অনুমানভিত্তিক রুটিন ঠিক করা হলো। সকাল বেলা দুধ আর কাগজ কিনতে এবং দ্বিতীয়বার কফি খেতে বাবা শহরের একটা ক্যাফেতে যান। প্রয়োজনে সুপার মার্কেটেও ঢুঁ মারেন। ফিরে এসে বাতাসে জলীয় বাষ্প ও গরম সত্তে¡ও দৌড়ে গেলেন পাহাড়গুলোর কাছে। একদিন সকালে ভয়ে কাঁপতে কাঁপতে ফিরে এলেন। ভেড়া পাহাড়া দেওয়ার কিছু কুকুর তার পথ আগলে ঘেউ ঘেউ করেছিল। যদিও শেষ পর্যন্ত তিনি অক্ষত রয়ে গেছেন।
আমি যা করি ওদের মা-ও তাই করেন- মেঝে ঝাড়– দেন, রান্না করেন, থালা-বাসন ধৌত করেন। দিনে কমপক্ষে একবার কাপড় শুকাতে দেন। একই রশিতে মিলে মিশে আমরা কাপড় শুকাই। কাপড়ের ঝুড়ি হাতে নিয়ে তিনি তাঁর স্বামীকে বলেন, তিনি কতই না সুখি। যেহেতু শহরের ঘিঞ্জি অ্যাপার্টমেন্টে থাকেন, তাই তিনি সেখানে খোলা আকাশের নীচে কাপড় শুকাতে পারেন না।
দুপুরের খাবারের পর বাবা মেয়েদের সমূদ্র দেখাতে নিয়ে যান। ঘাসের উপর লাফাতে থাকা ঝিঁ ঝিঁ পোকার পেছনে মেয়েরা ঘন্টার পর ঘন্টা ছোটাছুটি করে। ওদের ধরে একটা কাঁচের পাত্রে আটকে রাখে। সঙ্গে দেয় বাবার সালাদ থেকে লুকিয়ে রাখা টমেটোর কয়েকটি কুচি। ওদের পোষ মানিয়ে ফেলে। নামও দেয়। পরের দিন ঝিঁ ঝিঁ পোকাগুলো মরে যায়। কাঁচের পাত্রের ভেতর দম বন্ধ হয়ে। মেয়েরা কান্নাকাটি করে। একটা কূল গাছের নীচে ওরা মৃত ঝিঁ ঝিঁ পোকাগুলোকে কবর দেয়। তারপর কিছু জংলী ফুল ওদের কবরের উপর অর্ঘ্য দেয়।
একদিন বাবা দেখেন, একটা চটি জুতা হারিয়ে গেছে। জুতো জোড়া তিনি বাইরে রেখেছিলেন। বললাম, হয়ত কোন শেয়াল ওটা নিয়ে গেছে। আশপাশে শিকারের আশায় শেয়াল ঘুরে বেড়ায়। আমার বাবাকে ব্যাপারটা বললাম। বাবা আশেপাশে ঘুরেফিরে বেড়ানো সব বন্য-প্রাণীর মেজাজমর্জি জানেন। বাবা চটিজুতাটি উদ্ধার করলেন। সঙ্গে একটা বল আর একটা শপিং ব্যাগ। এগুলো পূর্ববর্তী পরিবারের যারা এখানে ছুটি কাটাতে এসেছিলেন, তাদের।
বুঝতে পারি, অতিথিরা গ্রামীণ প্রাকৃতিক ভূদৃশ্য কতই না পছন্দ করেন। এরা সবকিছুর ভূয়সি প্রশংসা করেন। এই উপষঙ্গগুলো তাঁদের ভাবতে, বিশ্রাম নিতে ও স্বপ্ন দেখতে সাহায্য করে। কালোজাম পাড়ার সময় মেয়েরা জামা মাখিয়ে ফেলে। মা অতোটা রাগ করেন না, বরং হাসেন। তিনি বাবাকে ছবি তুলে রাখতে বলেন। এরপর জামা খুলে নিয়ে ধোয়ার জন্য রাখেন।
একই সঙ্গে তাদের নির্জনতা সংক্রান্ত জ্ঞান আমাকে বিস্মিত করে। আমাদের ভগ্ন কুঠিরের প্রতিটি দিন একই রকমের। ওরা সেটা জানে। রাতে প্রচন্ড বাতাসের ধাক্কায় মাটি কেঁপে ওঠে। বৃষ্টির শব্দে ঘুম ভেঙ্গে যায়। মাসের পর মাস আমরা একা একা পাহাড়গুলোর মধ্যে কাটাই। এখানে ঘোড়া আছে, পোকামাকড় রয়েছে, মাঠে পাখি রয়েছে। ওরা এগুলোর ব্যাপারে জানে। ওরা যে নৈশব্দের কথা ভাবে, সেটি সারাটা শীত জুড়ে এখানে বিরাজ করে। এর সবই আমাকে বিস্মিত করে। সারাটা শীত জুড়ে যা বিরাজ করে, সেটা ওরা কীভাবে উপভোগ করে?

গত রাতে ওদের গাড়ি এসে পৌঁছল। বাবা-মার বন্ধুবান্ধবদের ওদের বাচ্চা-কাচ্চাসহ নিমন্ত্রণ জানানো হয়েছে। বাচ্চারা মাঠে ছোটাছুটি করে। এক দম্পতি বলেন, শহর থেকে আসার পথে কম ট্রাফিক জ্যাম পেয়েছেন। প্রাপ্তবয়স্করা বাড়ির চারপাশটা ঘুরে ঘুরে দেখেন। সূর্যাস্তকালে বাগানে পায়চারী করেন। বারান্দায় ইতিমধ্যে টেবিল লাগানো হয়েছে।
ওরা খাওয়ার সময় যে গল্পগুলো করছিলেন, সেগুলোর সবই আমার কানে আসছিল। আজ রাতে গল্পগুজব ও হাসাহাসির শব্দ একটু বেশিই। দেশের যতসব ঘটনা-দুর্ঘটনার বর্ণনা করে এই পরিবার। টমেটো খেকো ঝিঁ ঝিঁ পোকা, কুলগাছের নীচে ওদের শেষ কৃত্যানুষ্ঠান, ভেড়ার পাল পাহাড়া দেওয়া কুকুর, চটি জুতো চুরি করে নিয়ে যাওয়া শেয়াল। সব। ওদের মা বলেন, প্রকৃতির সান্নিধ্যে থাকা মেয়েদের জন্য ভালো।
এক সময় কেক এলো। সঙ্গে মোমবাতি। বুঝলাম, ওদের বাবার জন্মদিন। তাঁর বয়স পঁয়তাল্লিশ ছুঁই ছুঁই। সবাই গান গাইতে গাইতে কেক কাটে।
আমি আর বাবা কিছু বেশি পেকে যাওয়া আঙ্গুর ফল দিয়ে রাতের খাবার সারি। যখন টেবিল পরিষ্কার করছি ঠিক সেই সময় দরজায় কড়া নাড়ার শব্দ পাই। দেখি, মেয়েরা হাসপাস করছে। দুই ফালি কেকসহ থালাটি ওরা আমার দিকে এগিয়ে দেয়। একটা আমার, আর একটা বাবার। আমি ওদের ‘ধন্যবাদ’ বলার আগেই ওরা দৌড় দিয়ে চলে যায়।
অতিথিরা যখন দেশের রাজনীতি, ভ্রমণ আর শহরটি নিয়ে গল্পগুজব করছিলেন, তখন আমি কেক খেলাম। কেউ একজন ওদের মাকে জিজ্ঞেস করে- কেক কোথা থেকে সংগ্রহ করেছেন। তিনি বলেন, অতিথিদের একজন এটি নিয়ে এসেছেন। অতিথি সুর করে বেকারীর নাম বলেন। বাবা কাটাচামুচ নেওয়ার জন্য একটু ঝুঁকে যান। আমার দিকে তাকানোর পর মনে হলো- তিনি উত্তেজিত। হঠাৎ উঠে পড়ে সিগারেট খাওয়ার জন্য বাইরে অদৃশ্য হয়ে গেলেন।

আমরাও শহরে থাকতাম। বাবা পাবলিক প্লেসে ফুল বিক্রি করতো। মা তাকে সাহায্য করতো।
ওরা কয়েকদিন একে অপরের কাছাকাছি কাটালেন। লোকজন যে ফুলের তোড়াগুলো নিয়ে এসেছেন সেগুলো দিয়ে তারা টেবিল ও আঙিনা সাজালেন। এখন এই গ্রামীণ এলাকায় এরা ফুলের নাম জানেন- গোলাপ, সূর্যমুখী, পাতাবাহার, বেলী। এক সারি বালতির মধ্যে ফুলগুলোর ডগা পানিতে চুবিয়ে রাখা হয়।
এক রাতে তিনজন লোকের আগমন ঘটে। আমার বাবা তখন ছিলেন একা। আমি তখন আমার মায়ের পেটে। মা-ও বাড়িতে ছিলো। বাবা চাইছিলো না যে, এ সময় তিনি রাতে কাজ করুক। তখন বেশ দেরি হয়ে গেছে। বাজারের অন্য সব দোকানও বন্ধ হয়ে গেছে। বাবা তখন দোকানের লোহার ঝাঁপ নামাবে বলে। এক লোক এসে তাঁকে ঝাঁপ খুলতে বলল। বলল, সে তার মেয়েবন্ধুর সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে যাচ্ছে। একটা সুন্দর তোড়া চাইলো। বাবা তাকে একটি তোড়া বানিয়ে দিলো। লোকটা তখন মাতাল, খিটমিটে মেজাজের।
বাবা তোড়াটা দিতে গেলে লোকটা বলল, এটা ছোট হয়ে গেছে। সে আর একটু বড় তোড়া চাইলো। বাবা এতে আরও ফুল যোগ করলো। অবশেষে লোকটা সন্তুষ্ট হলো। বাবা তোড়াটা রঙিন কাগজ দিয়ে মোড়ালো। তারপর এতে রঙিন ফিতা জড়ালো। এরপর টাকা চাইলো।
লোকটি তার মানিব্যাগ থেকে কিছু টাকা বের করলো, তবে সেটি পর্যাপ্ত নয়। যখন বাবা এত অল্প দামে তোড়াটি তাকে দিতে অস্বীকৃতি জানালো লোকটি বাবাকে গর্দভ বলে গালি দিলো। বলল, সে জানে না কিভাবে একটা সুন্দর মেয়েকে উপহার দেওয়ার জন্য একটি তোড়া বানাতে হয়। এরপর সে অন্য আরো লোকদের সঙ্গে মিলে বাবাকে প্রহার করতে লাগলো। রক্তে বাবার মুখ ভরে গেল। সামনের দাঁতগুলো ভেঙ্গে গেল।
বাবা চিৎকার করলো। কিন্তু সে-সময় আশেপাশে কেউ ছিল না বলে কেউ তার চিৎকার শুনতে পেল না। ওরা ভয় দেখিয়ে বলল, যেখান থেকে এসেছিস সেখানে চলে যা। এই বলে বাবাকে মাটিতে ফেলে রেখে ফুলের তোড়া নিয়ে চলে গেল।
বাবা জরুরী চিকিৎসা সেবার জন্য হাসপাতালে গেল। এক বছর শক্ত কোন খাবার খেতে পারলো না। আমার জন্মের পর প্রথমবার আমার মুখ দেখেও সে একটি শব্দও উচ্চারণ করতে পারে না।
তখন থেকে কথা বলতে তার কষ্ট হয়। কথাগুলো মুখের মধ্যে জড়িয়ে যায়, যেন সে বুড়ো হয়ে গেছে। হাসতে লজ্জা পায়। দাঁত নেই তো তাই। আমি আর মা তাকে বুঝতে পারি, কিন্তু অন্যরা পারে না। সবাই ভাবে, যেহেতু বাবা ভীনদেশী, তাই সে ভাষা জানে না। মাঝে মাঝে ওরা বাবাকে বধিরও ভাবে। যখন বাগানে নাশপাতি আর লাল আপেল পাকে তখন আমরা ওগুলো ছোট ছোট ফালি করে কাটি। একেবারে পাতলা ফিনফিনে করে যাতে বাবা সেগুলো খেতে পারে।
তার এক স্বদেশী এই নির্জন এলাকায় কাজ করার কথা বলেছে। সে এই গ্রামাঞ্চলে পরিচিত নয়। আগে তো সবসময় শহরে থাকত। এখানে মুখ না খুলেই কাজ করতে পারবে। এখন আর সে আক্রান্ত হতে ভয় পায় না। সে বন্য প্রাণীর মধ্যে থাকতেই ভালোবাসে। জমি চাষ করতে পছন্দ করে। এই প্রাকৃতিক পরিবেশ তাকে রক্ষা করে। আমাকে স্কুলে নেওয়ার সময় বাবা এই একই কথা বলে। জীবনে সে কিছুই করতে পারেনি। সে চায়, আমি স্কুল শেষ করে কলেজে যাই, তারপর এদের কাছ থেকে অনেক দূরে চলে যাই।

পরের দিন সকালে একটু দেরিতে ওদের বাবা গাড়িতে মালপত্র উঠাতে শুরু করলেন। দেখলাম, চারজজনেরই গায়ের রং তামাটে। শারীরিক গঠনও একই রকমের। এরা যেতে চায় না। নাস্তা খেতে খেতে বললেন, আগামী বছরও তাঁরা এখানে বেড়াতে আসতে চান। সব অতিথি খাওয়ার সময় প্রায় একই কথা বলেন। খুব অল্প সংখ্যক অতিথি সত্যি সত্যিই ফিরে আসেন। কিন্তু বেশিরভাগই একবার এসে আর আসেন না। যাওয়ার সময় ওদের মা আমাকে ফ্রিজ দেখিয়ে বললেন, খাবারগুলো ওরা সঙ্গে নেবেন না; আমরা যেন খাই। বললেন, তিনি বাড়ির প্রেমে পড়ে গেছেন। ইতিমধ্যে মিস করতে শুরু করেছেন। যখন কাজের চাপে অনেক ক্লান্ত বোধ করবেন তখন এই বাড়ির কথা তার মনে পড়বে। এখানকার নির্মল হাওয়া, এই পাহাড় এবং সূর্যাস্তের সময় সমবেত উজ্জ্বল মেঘমালা।
ওদের যাত্রা শুভ হোক- বলে শুভকামনা জানালাম। বিদায় জানালাম। গাড়ি যতক্ষণ না দৃষ্টির আড়ালে চলে যায় ততক্ষণ দাঁড়িয়ে রইলাম। এরপর আবার নতুন অতিথিদের জন্য বাড়িটিকে প্রস্তুত করার কাজে মনোনিবেশ করলাম। বিছানা পাতলাম। মেয়ে দু’টো যে ঘর তছনছ করে রেখে গেছে সেটি পরিস্কার করার কাজে লেগে গেলাম। যে মাছিগুলো ওরা মেরেছে সেগুলো ঝাড়– দিয়ে ফেলে দিলাম।
যে জিনিসিগুলো ওদের দরকার নেই সেগুলোর কথা হয় ভুলে গেছে, না হয় ইচ্ছে করেই রেখে গেছে। মেয়েরা ছবি এঁকেছিল, সমূদ্র সৈকত থেকে ঝিনুক কুঁড়িয়ে এনেছিল। সেগুলো রেখে গেছে। শাওয়ার জেলও রেখে গেছে। কেনাকাটার লিস্ট, মায়ের ব্যবহৃত ছোট্ট খাতা, কয়েকটা পাতা যাতে আমাদের কথা লিখতে চেয়েছিলেন।

 

সীমানা
মূল: ঝুম্পা লাহিড়ী
অনুবাদ: এলহাম হোসেন

(ঝুম্পা লাহিরীর জন্ম ১৯৬৭ সালে লন্ডনে। বাবা-মা ভারতীয় অভিবাসী। তিন বছর বয়সে বাবা-মার সঙ্গে চলে যান যুক্তরাষ্ট্রে। তিনি ব্রিটিশ-আমেরিকান লেখক। লেখেন উপন্যাস, ছোটগল্প ও প্রবন্ধ। লিখতেন ইংরেজি ভাষায়। সম্প্রতি লিখছেন ইতালীয় ভাষায়। ১৯৯৯ সালে প্রকাশিত তাঁর প্রথম ছোটগল্প সংকলন ইন্টারপ্রিটার অব ম্যালাডিজ প্রকাশিত হয় এবং এই গ্রন্থের জন্য তিনি পুলিৎজার পুরস্কার লাভ করেন। তাঁর উপন্যাস দ্য নেইম সেইক (২০০৩) অবলম্বনে সিনেমা তৈরি হয়েছে। অনূদিত গল্পটি তাঁর ২০২৩ সালে প্রকাশিত রোমান স্টোরিজ গল্পসংকলন থেকে নেওয়া হয়েছে। এটি তাঁর দ্য বাউন্ডারি গল্পের বাংলা ভাষান্তর।)


আরও