মুআজ্জিনের আজানের সাথে সাথেই জেগে ওঠেন আব্বু-আম্মু উভয়েই। মুহাম্মদ কেও তাই নিয়ম করে উঠতে হয় তাদের সাথে। আব্বুর সাথে মুহাম্মদ চলে যায় মসজিদে, মা নামাজ পড়ে নেন বাসায়। মা নামাজ জিকির আজকার শেষে তাদের জন্য নাস্তা বানায়। নামাজ শেষে আব্বুর হাত ধরে বাসায় ফেরে মুহাম্মদ।
আজও নামাজের পর আব্বুর হাত ধরে বাসায় ফিরছে মুহাম্মদ। ইয়াসিন পড়া শেষে আব্বুর সাথে আম্মুর বানানো নাস্তা খেতে টেবিলে বসে মুহাম্মদ। নাস্তা খাওয়া শেষে আব্বু বাজারে যাচ্ছে বাজার করতে, সাথে মুহাম্মদ ও আছে। বাজারে যেতে তারা উটে একটা রিকশায়। রিকশাওয়ালাকে ভাড়া দেন আব্বু। ফিরতি টাকা হাতে হাঁটতে শুরু করেন। টাকা গুনতে গিয়ে দেখা গেল, রিকশাওয়ালা বিশ টাকার জায়গায় রেখেছে দশ টাকা।
বাড়তি টাকা ফেরত দিতে রিকশাওয়ালার দিকে দৌড়ে যান আব্বু, দশ টাকা দিয়ে বলেন, ‘দশ টাকা কম রেখেছেন আপনি। রেখে দিন এটা।’
রিকশাওয়ালা খানিক মিষ্টি হেসে টাকাটা নিয়ে নেন।
পুরোটা সময় তার আব্বুকে লক্ষ করে মুহাম্মদ । টাকা ফেরত দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে জিজ্ঞেস করে—
: আব্বু, ওই টাকাটা ফেরত না দিলে আল্লাহ কি অনেক নারাজ হতেন? আব্বু বললেন—
: মুহাম্মদ, অন্যের কিছু হাতে এলে তার জিনিস তাকে ফিরিয়ে দিতে হয়। না হয় তার অধিকার নষ্ট করা হয়, তার টাকার প্রতি লোভ করা হয়। আর অন্যের টাকার লোভ কখনোই করতে নেই। কারণ, লোভের পরিণাম অনেক ভয়াবহ হয়। তুমি কি হজরত ঈসা আলাইহিস সালামের সফর সঙ্গীর গল্পটি শোনোনি?
: না আব্বু, শুনিনি। কোন গল্পটি?
আব্বু বললেন, আচ্ছা বলছি শোনো!
একবার এক ইহুদি ঈসা আলাইহিস সালামকে বলল, আমি আপনার সঙ্গী হতে চাই। ঈসা আলাইহিস সালাম তাকে সঙ্গে নিয়ে নেন। সফরকালে তিনি খুব ক্ষুধার্ত হয়ে পড়েন। সাথে থাকা তিনটি রুটির দুটি তারা দুজন ভাগ করে খান আর একটি রেখে দেন।
কিছু সময় পর আল্লাহর ঈসা আ. ইহুদিকে জিজ্ঞেস করলেন, ‘আমি যে তোমার কাছে একটি রুটি রেখে গেলাম, সেটা আমাকে ফেরত দাও। ইহুদি রুটির কথা অস্বীকার করল। বলল, ‘আমি রুটি সম্পর্কে জানি না।’
আল্লাহর নবি কিছু বললেন না। চলতে লাগলেন। গাছপালা আচ্ছন্ন বনোপথ পাড়ি দেওয়ার সময় হরিণীর সাথে দুটি হরিণ শাবক দেখতে পেয়ে একটিকে ডাকলেন তিনি। হরিণ ছানাটি নবির কাছে ছুটে এলো। তিনি সেটিকে জবাই করলেন এবং আল্লাহর রহমতে সেটি নিজ থেকেই কাবাব হয়ে যায়। দুজন তৃপ্তিভরে সেখান থেকে আহার করলেন। খাওয়া শেষে ঈসা আ. বললেন, ‘হে হরিণ শাবক, তুমি জীবিত হয়ে যাও।’
তৎক্ষণাৎ সেটি জীবিত হয়ে তার মায়ের কাছে চলে গেল।
হজরত ঈসা আলাইহিস সালাম ইহুদির হাত ধরে জিজ্ঞেস করলেন, ‘কসম আল্লাহর, সত্যি করে বলো—রুটিটি কোথায়?
এই অলৌকিক কাণ্ড দেখেও ইহুদির হুঁশ ফিরল না। আগের মতোই সে বলল, ‘আমি কিছুই জানি না।’
পুনরায় চলতে শুরু করলেন তারা। বালুকাময় প্রান্তরে পৌঁছে ঈসা আলাইহিস সালাম বালুর স্তূপ করতে শুরু করলেন। তারপর বালুর স্তূপ লক্ষ করে বললেন, ‘হে বালুকারাশি, আল্লাহর হুকুমে স্বর্ণ হয়ে যাও।’
কী অবাক কাণ্ড, সাথে সাথে বালির স্তূপটি স্বর্ণে পরিণত হয়ে গেল। আল্লাহর নবি সেটাকে তিন ভাগ করে বললেন, ‘একভাগ আমার, আরেক ভাগ তোমার; তৃতীয় ভাগটি হলো, যে আমার সাথে থাকা তৃতীয় রুটিটি নিয়েছে—তার জন্য।’
স্বর্ণের লোভে পড়ে গেল ইহুদি। নিজ থলে থেকে রুটিটি বের করে বলে উঠল, ‘এই নিন আপনার রুটি। এটি আমার কাছেই ছিল।’
ঈসা আলাইহিস সালাম বললেন, ‘তুমি যেহেতু সত্য বলেছ, তাই আমার ভাগটিও তোমাকে দিয়ে দিচ্ছি।’
তারপর আল্লাহর নবি ইহুদিকে রেখে ভিন্ন পথ অবলম্বন করলেন।
ইহুদি স্বর্ণ নিয়ে আপন মনে আনন্দের সাথে পথ চলতে শুরু করল। কিছুক্ষণ পথ চলার পর দুজন ডাকাত তার পথ আগলে দাঁড়াল। তার কাছে থাকা স্বর্ণ দাবি করল। ইহুদি লোকটি বুদ্ধি করে বলল, এখানে তিনটি ভাগ রয়েছে স্বর্ণের। তোমরা দুজন এবং আমি। সুতরাং আমরা তিন জন স্বর্ণের এই তিনটি খণ্ড নিজেদের মাঝে ভাগ করে নিই, তবেই তো আর ঝগড়া-বিবাদ করতে হয় না।
ডাকাত বলল, সে হিসাব পরে করা যাবে। আগে তুমি বাজার থেকে আমাদের জন্য কিছু খাবার নিয়ে এসো। তারপর ভেবে দেখব কী করা যায়। লোকটি ডাকাতদের কথামতো বাজারে চলে গেল।
সে খাবারের সাথে বিষ মিশিয়ে আনার পরিকল্পনা করল। এদিকে ডাকাত দুজন ফন্দি আঁটল, খাবার নিয়ে আসার সাথে সাথে তাকে হত্যা করে ফেলব এবং স্বর্ণের টুকরোগুলো নিজেদের মধ্যে ভাগ করে নেব।
বিষমিশ্রিত খাবার নিয়ে ইহুদি ফিরতেই ডাকাতরা তাকে হত্যা করে ফেলল। ইহুদি লোকটিকে হত্যা করে তারা আনন্দের সাথে খেতে বসল। খাবারে যেহেতু ইহুদি বিষ মিশিয়ে এনেছিল, সুতরাং তারা সেখানেই মারা পড়ল। স্বর্ণও সেখানেই তাদের পাশে পড়ে রইল। কেউই তার মালিক হতে পারল না। লোভের কারণে মারা পড়ল তিন-তিন জন লোক। এজন্যই লোভ আমাদের জন্য কোনোভাবেই উচিত নয়, সব সময় এর থেকে দূরে থাকতে হবে।
আব্বুর মুখে লোভের পরিণতি শুনে মুহাম্মদ ভয় পেয়ে গেল। আর কখনো লোভ করবে না বলে সংকল্প করল। কারও কোনো প্রাপ্য ভুলে তার হাতে চলে এলে তা তার মালিকের কাছে পৌঁছে দেবে বলে আব্বুর কাছে প্রতিজ্ঞা করল। তারপর আব্বুর সাথে বাজার করে বাড়ির পথে পা বাড়াল।
লেখকঃ এইচ. এম.মাহমুদুল হাছান
ঠিকানাঃ সাতকানিয়া, চট্টগ্রাম, বাংলাদেশ।