শনিবার , ২১শে ডিসেম্বর, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ

প্রবন্ধ

কবিতার শিল্পগুণ : কবি ও পাঠকের দায়

আবু আফজাল সালেহ : কবিতা পাঠকের মনে যতটা চৈতন্য জাগাতে পারবে বা চৈতন্যকে আলোড়িত করতে পারবে কবিতার শিল্পগুণ সামানুপাতিক হারে বাড়তে থাকে। আবার পাঠকের জ্ঞানের পরিধি বা পাঠকের জ্ঞান-অভিজ্ঞতার উচ্চতা যতটুকু কবিতা থেকে তিনি ততটুকু শিল্পগুণ আদায় করতে পারবেন। কবিতা এক অনুপম শিল্প। তাই বলা যায়, কবি ও পাঠকের প্রকাশ ও গ্রহণের উপর নির্ভর করে কবিতার শিল্পরস বা শিল্পগুণ। রস হচ্ছে সাহিত্য বা কবিতার আত্মা। যে জাতিতে যত ভালো পাঠক সে জাতির বা ভাষার সাহিত্য ততটাই উন্নত। তাই বৌদ্ধিক পাঠক সৃষ্টি করতে না-পারলে সাহিত্যের উন্নয়ন ঘটানো খুবই কঠিন কাজ।

কবিতার অপরিমেয় শক্তি সাহিত্যের বিশুদ্ধতম শাখা। যুগে যুগে কবিতার মর্যাদার ক্ষুণ হয়নি। বিভিন্ন কারণে কবির অবমূল্যায়ন হলেও কবিতা টিকে আছে সুন্দর হয়েÑথাকছে অপরাজেয়। কবিতার গুণ ধরা দেয় প্রথমে কবির দক্ষতা ও কৌশল-প্রয়োগের ওপর, এরপর পাঠক-শ্রোতার আবিষ্কারের ওপর। আবিষ্কারের জন্য পাঠককে হতে হবে সজাগ, সজাগ হতে হলে প্রজ্ঞাবান হতে হবে, প্রজ্ঞাবান হতে হলে অনেককিছুই জানতে হবে। রংধুনু দেখে সৌন্দর্য পাই। রংধনু স¤পর্কে না-জানার লোকও সৌন্দর্য ভোগ করে। তবে যারা ‘কীভাবে রংধনু সৃষ্টি হয়’, ‘এর প্রক্রিয়া কী’ ইত্যাদি জানেন তারা অধিক মাত্রায় সৌন্দর্য উপভোগ করতে পারবেন। সাহিত্যের পাঠকের জন্যও একই ব্যাপার হয়ে দাঁড়ায়। কবির গুণে মল নিয়েও ভালো কবিতা রচিত হতে পারে, আবার ফুল নিয়েও কবির অদক্ষতায় নিকৃষ্ট কবিতা হতে পারে। পাঠকের বা গ্রহীতার পঞ্চইন্দ্রিয় অনুভ‚তির উঠানামার ওপর কবিতার মাধুর্য বা গুণ আবিষ্কার করে প্রকাশিত হতে পারে। দক্ষ পাঠকের হাতে পড়ে মোটামুটি একটি কবিতাও ভালো হিসাবে উপস্থাপিত হতে পারে। আবার কম মনোযোগী বা কম-জানা পাঠকের নিকট ভালো একটি কবিতাও খারাপ হিসাবে উপস্থাপিত হতে পারে। দক্ষ অনুবাদকের অভাবের কারণে বাঙলাসাহিত্যের অনেক ভালো কবিতা ভালোভাবে উপস্থাপিত হচ্ছে না। ফলে বিশ্বসাহিত্যে আমাদের পাঠক বৃদ্ধি করতে পারছি না! তবে ভালো-খারাপ কবিতার জন্য প্রথমত কবির দায়ই বেশি।

কনকনে শীতে ফুটপাতে বাচ্চাকে চাদরে মুড়িয়ে থাকতে দেখি। পাশ দিয়ে যখন পথিক যান, তাদের কেউ-কেউ বলবেন, শীতে খুব কষ্ট পাচ্ছে শিশুটি। কেউ হয়তো বলবেন মা শিশুটিকে ভালভাবে রাখতে চাচ্ছেন (আশ্রয়)। কেউ হয়তো এগুলো না ভেবে অন্যকিছু ভাবতে পারেন। কারও কাছে মাতৃত্বগুণ ধরা দিতে পারে, আরও কিছু..। কবিতার ক্ষেত্রেও তাই। পাঠকের দৃষ্টিকোণের রকমফেরে নানারকম অর্থ হতে পারে। অর্থগুলো বেশিরভাগ সঠিকই হবে। কিছু বোদ্ধা-পাঠকের কাছে কবিতার এমন গুণ ধরা পড়বে যে, কবিও তা ভাবেননি। এতে সংশ্লিষ্ট কবিও আরও সমৃদ্ধ হতে পারেন। পাঠকের দক্ষতা-অদক্ষতা বা জানা-কম-জানা ইত্যাদির কারণে কবিতার আসল সৌন্দর্য প্রকাশ হতে পারে বা আড়াল হয়ে থাকতে পারে। বাংলাসাহিত্যে সমালোচকের খুবই অভাব। সঙ্গে-সঙ্গে পাঠকের সংখ্যা কম, ভালো-মানের পাঠকের সংকট। ফলে সাহিত্যে বেশিদূর এগিয়ে যাচ্ছে না। কবিতার বই বা কবিতার রিভিউ খুব কম হয়। কেউ কেউ নিজেই করে অন্যের নামে ছাপেন। কেউ কেউ পরামর্শ বা অনুরোধ করে রিভিউ করান। আবার আদেশ দিয়েও কেউ কেউ বইয়ের রিভিউ বা আলোচনা করান। স্বতঃস্ফূর্ত রিভিউ বা আলোচনা খুব কমই হয়। যা আমাদের সাহিত্যের জন্য ভাল লক্ষণ নয়।

শিল্প-স্রষ্টা এবং পাঠক বা শিল্পভোগীর মানস-যোগাযোগ, উপলব্ধি বা অনুভ‚তির ওপর কবিতার মহত্ব নির্ভর করে। কবি কবিতা লিখে প্রচার করে দেনÑমানে ছাপিয়ে দেন। এরপর সে কবিতা আর সে-কবির থাকে না। কবিতাটি হয়ে যায় পাঠকের, শ্রোতার বা শিল্পভোগীর। এ গোষ্ঠীর নিপুণ হাতে কবিতা হয়ে ওঠে উন্নত, না-হয় মরে যায়। কবির করার কিছুই থাকে না! যথাযথ মাধ্যম বা পাঠক না-পেয়ে অনেক সম্ভাবনাময়ী কবির মৃত্যু হয়। আবার কম-প্রতিভাবান কবির কবিতা স্বর্গে উঠে যায়-যদিও মহাকালে সত্যিকারের কবিতায় টিকে থাকে। জীবনানন্দ দাশের অহেতুক সমালোচকগণের খবর বেশিরভাগই জানে না, কিন্তু জীবনানন্দকে যুগ যুগ ধরে মনে থাকবেন। এরকম অনেক উদাহরণ আছে বিশ্বসাহিত্যে। তাই বলা যায়, পাঠকের কেরামতিও আমাদের দরকার। তারজন্য দরকার পরিবেশ, পাঠাগার, পড়াশুনা। সাহিত্যের উন্নতির জন্য সাহিত্যরচনার পাশাপাশি পাঠকসৃষ্টি এবং তাদের আত্ময়োন্নয়ন এবং উল্লিখিত-সহ ইতিবাচক পদক্ষেপ নিতে সোচ্চার হওয়া দরকার, ক্ষেত্রমতে উদ্যোগী হওয়া দরকার। এতে সাহিত্যিকের জন্যই লাভ বেশি, বেশি লাভবান হবে বাঙলাসাহিত্য। ভালোপাঠক দেশের সুনাগরিক হবে, দেশ তাদের কাজে লাগাতে পারবে।

ভালো-সমালোচকরা ভালো পাঠক। দক্ষতার অভাব বা অপপ্রয়োগের ফলে ভালো কবিতা বা সাহিত্যকে খারাপ বলে চালিয়ে দেন অনেকে। অনেকে হিংসা-বিদ্বেষপ্রসূত হয়ে এমন করেন। এতে সাহিত্যিকের মনোবল ভেঙে যেতে পারে আবার সমালোচনা-সহ্যকারী অনুপ্রেরণা পেয়ে আরও ভালো লেখা আবিষ্কার করতে পারেন। সাহিত্যে এমন অনেক উদাহরণ আছে। জীবনানন্দের কথা আগেই উল্লেখ করেছি। আরও নাম-করা কয়েকটি ঘটনা তুলে ধরা যাক। রবীন্দ্রনাথ মাইকেলের ‘মেঘনাদবধ’ মহাকাব্যকে উন্নতশৈলী বলে মত দেননি। পরে এ মহাকাব্য অনেকের প্রশংসা পেয়েছে। রবীন্দ্রনাথও পরে ভালো বলে মত দিয়েছিলেন। রবীন্দ্রনাথের মন্তব্যে প্রথমে পাঠকপ্রিয়তা কম হয়েছিল। ১৯১৩ সালের ঘটনা। ফরাসি কবি গিয়াম আপলিনের ‘অ্যালকুল’ কবিতার বই বের হয়। দুশ পাতার এ-বইয়ের বৈশিষ্ট্য হচ্ছে কোনও কবিতায় যতিচিহ্ন নেইÑকমা, দাঁড়ি, সেমিকোলন ইত্যাদি। নতুন এ-ধারা তখনকার ইংরেজি-সাহিত্যিক-পাঠক মেনে নিতে পারেননি। দুয়ামেল-এর নেতৃত্বে অনেকেই কঠোর বিরোধিতা করেছেন, ব্যক্তিগত আক্রমণ করেছিলেন। পরে অবশ্য ভুল বুঝতে পেরে আগের বক্তব্য প্রত্যাহার করে নেন দুয়ামেল। পাউন্ড ও এলিয়েট প্রথমে মিলটনের কবিতাকে ‘কবিতা’ই মনে করেননি! নেতিবাচক লেখার ১১ বছর পরে ১৮০-ডিগ্রি ঘুরে গিয়ে এলিয়েটকে বলতে হয়, মিলটনের কবিতার অনুশীলনে লাভবান হবেন কবিরা। সাহিত্যের ইতিহাস বলে, সত্যিকারের প্রতিভা ও প্রথাবিরোধিতা ভবিষ্যতে টিকে থাকে। অনিরপেক্ষ পাঠক-সমালোচক হারিয়ে যান। সমালোচকগণও একপ্রকারের পাঠক। ফলে লেখকের বিকাশে ভালো-পাঠকের একটা বিশেষ ভ‚মিকা থাকে। And wholly given over to unfamiliar affections;/To find his happiness in another kind of wood/And be punished under a foreign code of conscience.The words of a dead man/Are modified in the guts of the living (W. H. Auden): কবি অডেন সম্ভবত সাহিত্যিক যোগাযোগে পাঠকের সক্রিয় ভ‚মিকার উপলব্ধির কথা বলতে চেয়েছেন। একজন কবির কবিতা পাতায় কালো দাগ থেকে যায় যতক্ষণ না সেগুলিকে তার পাঠকরা তাদের নিজস্ব জগতের প্রেক্ষাপটে নতুন করে জীবন ধারণ করে। নতুন করে জীবন দেওয়ার প্রধান মাধ্যম হল সমালোচনা করা, আলোচনা করা। সাহিত্য-আলোচনায় যোগাযোগ একটি একমুখী প্রক্রিয়া। লেখক পাঠকের সঙ্গে যোগাযোগ করে থাকেন। পাঠক লেখকের অগ্রসরতা নিয়ে চিন্তা করেন। Literature as communication হিসাবে লেখক ও পাঠক উভয়ের মানস-বিকাশের পরিমাণের ওপর কবিতার শিল্পমান নির্ভর করে থেকে। বুদ্ধি, প্রজ্ঞা, সৌন্দর্য, কল্পনা ইত্যাদি সাহিত্য-পাঠকের যোগাযোগের গভীরতা নির্ভর করে থাকে; চিন্তা বা ভাবনার পরিধিকে বিস্তৃতি করতে সহায়তা করে থাকে। প্রকৃতপক্ষে, পাঠক পিয়ানো-বাদক এবং পাঠ্য একটি বাদ্যযন্ত্র। বাদক বা পাঠক যন্ত্রটিকে বাজায়। আর কী-বোর্ড হল জীবন ও সাহিত্যের সাথে তার নিজের অতীত অভিজ্ঞতার পরিসর।

 


আরও