সোমবার , ৭ই এপ্রিল, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ

অনুবাদ

বেন ওকরির দু’টি গল্প -অনুবাদ: এলহাম হোসেন

সেই গভীর খনিগুলো

আফ্রিকা বলতে যে স্থানটিকে বুঝি, সেখানে খনিগুলো পাওয়া গিয়েছিল। ওটা একটা ম্যাগাজিনের ছেঁড়া পাতার উচ্ছিষ্টাংশ।

কেবলমাত্র খনি থেকে যখন বেরিয়ে আসি তখনই আমার মনটা খুশিতে ভরে যায়। বক্সাইটের গুড়োয় শরীরটা ঢেকে যায়। চোখের চারপাশে চক্রাকারে জমে থাকে। সাদামাঠা পোশাক আর কাপড়ের জুতা পড়ে খনিতে নেমে পড়ি। ওরা ড্রিল করে। ধূলোর গুড়ো নি:শ্বাসের সঙ্গে ফুসফুসে ঢুকে পড়ে। পড়ে যখন নাক ঝাড়ি, দেখি শুধু রক্ত আর রক্ত।
ভাবলাম, এটাই স্বাভাবিক। পরিবারকে খাওয়ানোর জন্য পয়সা পাই। কেউ কখনও বলেনি যে, আয় রোজগাড়ের অন্য কোন পথ আছে।

সবসময়ই আমি স্কুলে যেতে চাইতাম। কিন্তু আমার শিশুকালে মা মারা গেল। আমার বাবা যে মাকে খুব ভালোবাসত, মার মৃত্যুর পর সে-ও বেশিদিন বাঁচলো না। আমাদের দেখাশুনা করার আর কেউ রইলো না। শ্রীঘ্রই আমরা সাত ভাইবোন রাস্তায় নেমে গেলাম।
আমাদের আত্মীয়স্বজন আমাদের কোন খোঁজ খবর নিলো না। কেউ কেউ চেষ্টা করলো। কিন্তু ওদেরই তো অনেক সমস্যা। ধীরে ধীরে আমরা ভাইয়েরা এদিক ওদিক ছড়িয়ে পড়লাম। যে লোকের বাড়িতে আমার বোন কাজ করত, তার দ্বারা সে গর্ভবতী হয়ে পড়লো। এরপর আর তার কোন হদিস পেলাম না।

একদিন এক লোক বলল, আমি সহজেই কিছু কামাতে চাই কি না। বললাম, হ্যাঁ। এরপর সে আমাকে একটা লোকে ঠাসা ট্রাকে করে নিয়ে গেল। শহর থেকে অনেক দূরে। তারপর ওরা আমাকে এখানে নামিয়ে দিলো। কিছু বুঝে ওঠার আগেই আমরা মাটির গভীরে চলে গেলাম। প্রথম দিনেই মনে হলো আর বাঁচব না। ভাবলাম, জাহান্নামের উদ্দেশে রওনা দিয়েছি।

আমার সঙ্গেও অন্য সকলেও প্রথমবারের মতো মাটির গভীরে নামলো। জানিনা, এদেরকে ওরা কোত্থেকে যোগার করেছে। সবাইকে দেখতে ফ্যাকাশে। ফেরারী কুত্তার মতো, যার কোন ঘর নেই, ঠিকানা নেই। এরা মরে গেলে কেউ চেয়ে দেখে না, পাত্তা দেয় না।

আমরা খনি-শ্রমিক। কাজ শুরু করার পর বেশি দিন হয়নি। একটি ঘটনার কথা এখনও মনে পড়ে। আমরা তখন খনির ভেতরে। হঠাৎ ভুমিধ্বস হলো। কেউ এলো না আমাদের উদ্ধার করতে। সব পথ, মাটি আমাদের উপর ধ্বসে পড়েছে। ভয়ানক লাল ধূলোয় আমাদের শ্বাস নিতে হলো। অল্প যে কজন বেঁচে গেলাম তারা নিজেরাই মাটি খুঁড়ে খুঁড়ে বেরিয়ে এলাম। প্রায় সারাদিন লাগলো। যখন আমরা খনি থেকে বেরিয়ে আলোতে আসলাম তখন খনি ধ্বসের অপরাধে ওরা আমাদের জরিমানা করলো। তারপর জেলে পাঠালো। জেলে থাকতে খবর পেলাম যে, আরোও চারটি খনিতে ধ্বসের ঘটনা ঘটেছে।

এরপর উত্তরাঞ্চলে ভূমিকম্পের ঘটনার খবর পেলাম। শুনলাম, মাটিতে ফাটল হয়েছে এবং সেখানে পুরো গ্রাম ধ্বসে গেছে। আমরা ভূমিধ্বস ও বনভূমির নিশ্চিহ্ন হয়ে যাওয়ার খবর পেলাম। শুনলাম সমূদ্রের ঢেউ ছুটে আসছে শহরের দিকে। ট্রাক্টর, অফিস, ফুল-সবকিছুকে গ্রাস করছে। টর্নেডোর খবর পেলাম। বাড়িঘরগুলো শূন্যে উড়িয়ে নিয়ে গেছে। শহরগুলোর উপর দিয়ে ঝড় বয়ে যাচ্ছে। আকাশে উঠছে, তারপর আছড়ে পড়ছে শহরের উপর। আমরা ঝড়ে গাছ-গাছরা উপড়ে পড়ার খবর পেলাম। ভীতসন্ত্রস্ত মানুষ আর গীর্জাগুলো হারিকেনের আঘাতে পর্যুদস্ত হয়ে পড়েছে।

এরপর শুনলাম যে পৃথিবীটাকে আমরা চিনি সেটি আর নেই। এটি ঝড়ের মধ্যে বিলীন হয়ে গেছে। কেউ জানে না, কোথায় গেছে। মনে হলো শুধু যারা আমরা খনিতে আটকে পড়েছিলাম ও জেলে ছিলাম, তারা নিরাপদে আছি। ঝড়ে কারাগারের ছাদ উড়ে গেল। কিছু সময়ের জন্য আকাশটা যেন আমাদের সামনে অবারিত মুক্তির পথ মেলে ধরলো। এরপর আমরা ফিরে গেলাম এমন এক পৃথিবীতে যেখানে শুধু পাথর আর পাথর।

স্টেট ডিপার্টমেন্ট অস্বীকার করেছে

এক টুকরো ধাতব বস্তু থেকে ওটা খসে পড়েছিল। অনেকদিন আমরা কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে ছিলাম। অবশেষে ভাবলাম, আচ্ছা এতে কোন তথ্য লেখা নেই তো। খোলার পর এর মধ্যে অনেকগুলো ফটো দেখতে পেলাম। সেগুলো একটা পরিবারের। একটা শহরের। বিড়ালের ছবি। প্লাবিত রাস্তার ছবি। মিছিলের ছবি। প্রথমে ছবিগুলো দেখে বুঝা যায়, সবাই আনন্দে আছে। কিন্তু ধীরে ধীরে সবার ওপর বিষন্নতা ভর করে। প্রেমপত্রের কিছু ছেঁড়া অংশও ছিল। একটা কবিতার শুরুর দিকের কয়েকটি লাইন ছিল। বাচ্চার হাতে আঁকা ছবি। তারপর এই জিনিসটা। সব আলামত দেখে বুঝা যায়, এসব উপষঙ্গ প্রকাশ করার বিষয় নয়। বরং গোপন স্বীকারোক্তি হিসেবে লেখা নথি। মনে মনে ভাবলাম, কোন সরকারী কর্মকর্তা এটি লিখেছেন। বুঝা যায়, তথ্য-উপাত্তে তাঁর ছিল অবাধ বিচরণ।

জলবায়ু পরিবর্তনের বানোয়াট গল্প নিয়ে স্টেট ডিপার্টমেন্ট আজকে রিপোর্ট ছেড়েছে। প্রেসিডেন্ট, যিনি স্বভাবতই জলবায়ু পরিবর্তনের ধারণার ঘোর বিরোধী, তিনি নিজে বিবৃতিটি দিয়েছেন। ওভাল অফিস থেকে। কাটছাঁট করে। সংবাদ মাধ্যম আবার খবরটি বার বার প্রচার করে। তিনি চেয়েছিলেন আনুষ্ঠানিকভাবে মানুষকে হতাশায় পাগল করে দেওয়া এসব জল্পনা-কল্পনা শেষ করে দিতে। তিনি সোজাসাপ্টা বলেন, প্রকৃতির নানান পরিবর্তন, বারবার বন্যা, সৈকতে আছড়ে পড়া বিপুলসংখ্যক টাইফুন, দাবানল যাতে ক্যালিফোর্নিয়ার অর্ধেক বনভূমি উজার হয়ে গেছেÑ এগুলো হলো স্বাভাবিক প্রাকৃতিক ঘটনা। আমাদের সাধারণ ধারণার বাইরে এগুলো কিছুই নয়। বছরের পর বছর ধরে এসব ঘটনা ঘটে চলেছে। এ ঘটনাগুলো ঘটছে মানে এই নয় যে যুদ্ধ চলছে।

বছরের পর বছর ধরে ঘটতে থাকা অদ্ভূত সব ঘটনা নিয়ে গবেষণার জন্য ডিপার্টমেন্ট গবেষণা প্রকল্প শুরু করেছে। প্রতি বছরই অদ্ভূত সব ঘটনা ঘটে। সত্যি সত্যিই এসব গত একশ বছর ধরে ঘটে চলেছে। মনে হয়, আমাদের সময় ঘটে যাওয়া ঘটনার আমরা অতিরঞ্জন করি। এগুলোকে তুলনারহিত মনে করি। প্রতিনিয়ত অঘটন ঘটে চলার রিপোর্ট এদিক-সেদিক করা একটা রীতি হয়ে দাঁড়িয়েছে। অতীতের যুগগুলোর সঙ্গে তুলনা করলে আমাদের সময়েই অপেক্ষাকৃত কম দুর্ঘটনা ঘটে বলে মনে হয়। ভিসুভিয়াসের অগøুৎপাতের কথা ভাবুন। পম্পের কথা ভাবুন। যে দাবানল সপ্তাহের পর সপ্তাহ ধরে চলেছিল। প্রথম দিকে উষ্ণায়নের কথা ভাবুন যার ফলে পৃথিবীতে হোমোসেপিন্সের আবির্ভাব ঘটেছিল। সেই জলবায়ু পরিস্থিতির কথা ভাবুন যা পশমে ঢাকা ম্যামথদের অস্তিত্ব বিলীন করে দিয়েছিল।

এখন আর এ কথা বলা বিজ্ঞানীদের ফ্যাশনের ব্যাপার নয়। জনগণও তাদের শুলে চড়াবে না। বরং তাঁরা তাঁদের নিজেদের রিপোর্টে জলবায়ুর এমন তারতম্যের কথা উল্লেখ করেছেন। সহ¯্র বছর ধরে দাবদাহ, ঝড় পৃথিবীর ইতিহাসের অংশ হয়ে দাঁড়িয়েছে। মানুষ যখন ধর্ম গ্রহণ করলো তখন প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের জন্য ঈশ^রের গজবকে দোষারোপ করলো। এখন এরা সরকার ও কর্পোরেটদের দোষারোপ করে। আমরাই এখন অভিনব দেবতা। আমরা ঘোষণা করে দিয়েছি যে, বিশে^র উষ্ণায়ন বলে কিছু নেই।

যদি থেকেও থাকে, তো তাতে কী হয়েছে? মঙ্গলে আমাদের বাসস্থান ঠিক করছি। ওখানে সব নতুন করে শুরু করব। বাছাইকৃত অল্প কিছু মানুষ নিয়ে। লোকজন কেন ভাবে যে, পৃথিবীকে প্রতিস্থাপন করা যাবে না!

বিশ^ব্রহ্মাÐে লক্ষ লক্ষ গ্রহের মধ্যে শুধু পৃথিবীটাই স্থির ও প্রাণের বাসযোগ্য স্থানÑ এ বিষয়টি দৈব ঘটনা মাত্র। তবে পৃথিবীর এই স্থিরতা সবসময়ই নাজুক। মানুষের বিবর্তন অনবরত চলছে। বিবর্তন মানেই ধ্বংস। এটিই বিবর্তনের সূত্র। আমরা সবসময়ই আমাদের পায়ের নীচ থেকে বইটাকে লাথি মেরে ফেলে দিই। এভাবেই আমরা এগিয়ে যাই।

বিবর্তনের উপজাত হলো দুষণ। সভ্যতার জন্য আমরা মূল্য দেই। আমরা যারা চাই তারা আলাদাভাবে বিবর্তিত হই। আর এভাবে আমরা শুধু ইতিহাস নয়, বরং যেসব সুযোগ সুবিধা ভোগ করে এসেছি সেগুলোও অস্বীকার করি। যারা পশ্চিমা ভোগবিলাসের মধ্যে বাস করে সেসব ভবিষ্যতবক্তাদের আমি থামাতে পারব না। তাদের কাজকর্ম অন্য সংস্কৃতিকে ধ্বংস করে দেয়। কত বড় বড় অপরাধ যে করেছে পশ্চিমা সভ্যতা, তার কোন ইয়ত্তা নেই। তারা কি এখন শেষ মুহূর্তে এসে ইতিহাসের সঙ্গে মিশে গিয়ে ঘড়ির কাঁটা উল্টো দিকে ঘোরাতে চায়? কিন্তু ভবিষ্যতবক্তাদের কথা যদি ঠিক হয় তবে কী হবে? কী হবে যদি রাষ্ট্রপতি আমাদের শেষ পরিণতির দিকে ঠেলে দেন? পৃথিবী যখন পুড়ছে, আমরা যদি তখন বাঁশি বাজাই তাহলে কী হবে? পৃথিবী পুড়ছে তো পুড়ছেই। অ্যামাজনে পুড়ছে। অষ্ট্রেলিয়া পুড়ছে। যুক্তরাষ্ট্রের সর্বত্র পুড়ছে। ক্যাথেড্রালগুলো পুড়ছে। যাজকগণ আগুনের উপর বসে আছেন। হিমবাহগুলো বাষ্প হয়ে উবে যাচ্ছে। শহরগুলোতে আগুন লেগেছে। যে জায়গাগুলোতে বরফ পড়ার কথা সে জায়গাগুলোতে তাপদাহ চলছে।

যে রাষ্ট্রপতি আমাদের সবাইকে মৃত্যুর দিকে চালিত করছেন তাঁকে সমর্থন করে আমরা কী করছি? যে কাজ আমাদের সবাইকে ধ্বংস করে দিতে পারে সেটিকে সমর্থন করতে আমাদের কী বাধ্য করছে? দায়িত্বের কি সীমা-পরিসীমা নেই? আমি অস্বীকার করাকে বিশ^াস করি না। কিন্তু আমি ভালো বেতন পাই। সামর্থ্য অনুযায়ী আমি সবচেয়ে ভালো অবস্থানে আছি। এখানে যা মিথ্যা, তা প্রচার করতে আমি শুধু আমার দক্ষতাই ব্যবহার করছি না, আমি বড় বড় মিথ্যার মধ্যে সংঘর্ষও লাগিয়ে দিচ্ছি। সাময়িক মিথ্যা বলতে, পৃথিবী ধ্বংসের ব্যাপারে মিথ্যা এবং এমনকি সব মিথ্যাকে ঢেকে ফেলার জন্য আরেক মিথ্যা তৈরিতে আমার দক্ষতা তৈরি করছি।

আমি তো নিজের চোখেই দেখছি, পৃথিবীতে কোন কিছুই ভালো চলছে না। গতকাল যখন আমার মেয়েকে স্কুলে নিয়ে যাচ্ছিলাম তখন একটা ইগুয়ানা আকাশ থেকে আমার পায়ের কাছে এসে পড়লো। আমার পাঁচ বছর বয়সী মেয়ে যার কাছে চারপাশের সবকিছু বিস্ময়ের সে বলল,
বাবা, ইগুয়ানাগুলো আকাশ থেকে পড়ছে কেন?
ওকে আমি কী বলব? আমি কি ওকে রাষ্ট্রপতির মিথ্যা কথাটা বলব? যে এটা তেমন অস্বাভাবিক কোন ঘটনা নয়। এমনটা সচরাচর ঘটেই থাকে? আমি চুপ করে থাকলাম। ভাবলাম, ওর মন অন্য কিছুতে ব্যস্ত হয়ে পড়বে। কিন্তু আমি পাঁচ বছর বয়সী একটি শিশুর কৌতুহলী মনের কথা ভুলেই গেলাম।
“বাবা, কেন ইগুয়ানা আকাশ থেকে পড়ছে? এই মাত্র একটা পড়েছে দেখ। কেন…?”
“মাঝে মাঝে এমনটা ঘটে, সোনা,” আমি বললাম।
“ঈশ^র কি এদেরকে ছুঁড়ে ফেলে দিচ্ছে? ঈশ^র কি ইগুয়ানাগুলোর উপর রাগ করেছেন, বাবা?”
“নাহ,” আমি বললাম। “ঈশ^র ইগুয়ানাগুলোর উপর রাগ করেননি।”
“ঈশ^র কি আমাদের উপর রাগ করেছেন?”
এবার আমি থেমে গেলাম। আমার ভেতরটা মোচড় দিয়ে উঠলো। হুডনি যেমন পেটে ঘুসি খেয়ে মারা যায়, প্রশ্নটি আমার পেটে ঠিক তেমনি আঘাত করলো। এমন ঘুসি আপনি খেলে দুদিন পরে মারা যাবেন।
“ওটা কী, সোনা?”
“ঈশ^র আমাদের উপর রাগ করেছেন কেন?”
“ এ কথা কেন বলছো, সোনা?”
সে তার ছোট হাতটি আমার হাত থেকে ছাড়িয়ে নিলো। ওখানে থেমে আকাশের দিকে তাকালো। তারপর চোখে মুখে একটা টানটান ভাব ফুটিয়ে তুলল।
“উনি যেভাবে ইগুয়ানাগুলোকে ছুঁড়ে মারছেন, সেটা দেখে আমি প্রশ্ন করলাম।”
হতবুদ্ধি হয়ে আমি দাঁড়িয়ে গেলাম। প্রথমবারের মতো আমি এমন এক মিথ্যার ফাঁদে পড়ে গেলাম যেটি আমি তৈরি করছি সেই ব্যক্তিকে লালন পালন করার জন্য যে আমাকে নিষ্পাপ মনে প্রশ্নগুলো করেছে।
“ঈশ^র ওগুলো ছুঁড়ে ফেলছেন না।”
“তাহলে কে?”
আবার চুপ হয়ে গেলাম।
“কেন এত এত মানুষের কোন বসবাসের ঘর নেই, বাবা? ওরা কেন রাস্তায় ঘুমায়?”
“কারণ, ওদের ঘর-বাড়ি সমূদ্রের তলায় তলিয়ে গেছে।” নিজের অসহায়ত্বে হাপিয়ে উঠে বেশি কিছু না ভেবেই উত্তরটি দিলাম।
“কিন্তু সমূদ্র এত উঁচু হয়ে উঠলো কেন?”
“ব্যাখ্যা করা কঠিন।”
“আমরা কি সবাই তাহলে সমূদ্রে তলিয়ে যাচ্ছি, বাবা?”
প্রথমবারের মতো আমার মেয়ের বুদ্ধিমত্তার ব্যাপারে নড়েচড়ে বসলাম। মনে হলো, সে লুক্কায়িত কোন জ্ঞানের দ্বারা তাড়িত হয়ে কথাগুলো বলছে। সে আমার দিকে এমনভাবে তাকায় যেন আমি কিছু একটা জানি, অথচ ওকে বলছি না। হতে পারে, এটি শিশুদের স্বাভাবিক সন্দেহ প্রবণতা।
“অবশ্যই আমরা সবাই সমূদ্রের তলায় হারিয়ে যাব না,” হঠাৎ করে বলে ফেললাম।
দম বন্ধ করে সে আমার দিকে সায় না দেওয়া চোখে তাকালো।
“এমন মজার ধারণা কোথায় পেলে?” যতটা সম্ভব নমনীয়ভাবে জিজ্ঞেস করলাম।
“স্কুলের অন্য সব বাচ্চাদের কাছ থেকে।”
“ওদের কথায় কান দেবে না। ওরা কিছু জানে না।”
“তুমি কি জানো, বাবা?”

আরেকটা ইগুয়ানা আমাদের পায়ের কাছে পড়লে আমার ঘাম ঝরতে লাগলো। এবার আর সে বিস্মিত হলো না। শুধু আমার দিকে ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে চলতে লাগলো।
এভাবেই প্রতিদিন চলি।

হঠাৎ কাঁদতে শুরু করি। জানি না, কেন। থামতেও পারি না। কাঁদতে কাঁদতে ওর মুখের কাছে আমার মাথাটা নামিয়ে আনলাম। রাস্তার সবাই ব্যাপারটা খেয়াল করলো। এতে ব্যাপারটি একটু খারাপই হলো।

আমার পীঠে চাপড় দিয়ে মুখে হাত রেখে আমার মেয়ে বলল, “চুপ করো, চুপ করো। মন খারাপ করো না, বাবা। আমরা সবাই সমূদ্রের তলায় হারিয়ে যাচ্ছি। আমাদের মাছের মতো বাঁচতে শিখতে হবে।”

 

( বেন ওকরি নাইজেরিয়ার সাহিত্যিক। এখন থাকেন ইংল্যান্ডে। জন্ম ১৯৫৯ সালে। মূলত উপন্যাস লেখেন। কবিতাও লেখেন। ১৯৯১ সালে তিনি তাঁর উপন্যাস দ্য ফেমিশ্ড রোড- এর জন্য বুকার পুরস্কার জেতেন। ২০২৩ সালের শেষের দিকে প্রকাশিত হয় তাঁর টাইগার ওয়ার্ক নামক গ্রন্থ। এটি মূলত ইকোক্রিটিক্যাল টেক্সট। এতে কিছু ছোট ছোট গল্প আছে। কবিতাও আছে। আসন্ন পরিবেশ বিপর্যয়ের ব্যাপারে লেখকের উদ্বিগ্নতা প্রকাশ পেয়েছে বইটির সব গল্প ও কবিতায়। অনুদিত গল্পগুলো এই গ্রন্থ থেকে নেওয়া হয়েছে।)


আরও