আধুনিক বাংলা কবিতার মূল সুর ঐতিহ্যের উত্তরাধিকার। একইসঙ্গে নিঃসঙ্গতা, হতাশা, বিশ্বাস-অবিশ্বাসের দোলাচল, অন্ধবিশ্বাসের পরিবর্তে সন্দেহ, প্রশ্নশীলতা ও যুক্তিবোধ। যদিও আধুনিকতাবাদীদের দাবি, আধুনিক কবিতায় পল্লীর চিত্র অঙ্কনের পরিবর্তে নগরায়ন, তবে তা পুরোপুরি সত্য নয়। প্রকৃত সত্য এই যে—আধুনিক কবিরা স্বকালের চিত্র অঙ্কনের ক্ষেত্রে গ্রামীণ পটভূমির পাশাপাশি নগরজীবনকেও সমান মহিমায় কবিতায় অঙ্গীভূত করে তোলেন।
আধুনিক যুগ—যন্ত্রসভ্যতার, প্রযুক্তির, অবাধ তথ্যপ্রবাহের। যুগ ধর্ম-যুগপ্রবাহের প্রভাবে আধুনিক মানুষের জীবনে হয়ে উঠেছে জটিল ও দ্রুতগতিসম্পন্ন। জটিল এই অর্থে যে, আধুনিক কালের বাসিন্দাদের জীবনের কোনো দিককে সরলভাবে দেখার সুযোগ নেই। সুযোগ নেই ব্যক্তিগত গোপনীয়তা রক্ষারও। আবার দ্রুত গতির কারণে ধীরগতির মানুষেরা পিছিয়ে পড়ার আশঙ্কা থেকেই যাচ্ছে। ফলে সমাজের গতির সঙ্গে তাল মেলানোর স্বার্থে আধুনিক কালের বাসিন্দাদের ক্রমাগত ছুটেই চলতে হয়। এই ছুটে চলার গতি ও জীবনের জটিলতা কবিদের মধ্যেও সংক্রমিত হয় খুব সহজেই। এই সংক্রমণের ফলে তাঁরা জীবনকে চিত্রায়িত করার সময় জীবনাভিজ্ঞতা, কল্পনা ও প্রজ্ঞার সম্মিলন ঘটান। এই সত্য বাংলা কবিতার প্রথম আধুনিক পুরুষ জীবনানন্দ দাশ, সুধীন্দ্রনাথ দত্ত, বুদ্ধদেব বসু, অমিয় চক্রবর্তী, বিষ্ণু দে, প্রেমেন্দ্র মিত্র, সমর সেন থেকে শুরু করে সুভাষ মুখোপাধ্যায়, আহসান হাবীব, আবুল হোসেন, সৈয়দ আলী আহসান, শামসুর রাহমান, শঙ্খ ঘোষ, শক্তি চট্টোপাধ্যায়, আল মাহমুদ, সৈয়দ শামসুল হক, শহীদ কাদরী, ফজল শাহাবুদ্দিন, ওমর আলী, দিলওয়ার, হয়ে আবুল হাসান, সিকদার আমিনুল হক, রফিক আজাদ, মহাদেব সাহা, অসীম সাহা, নির্মলেন্দু গুণ, হেলাল হাফিজ, মুহাম্মদ নূরুল হুদা ও আসাদ চৌধুরীর ক্ষেত্রেও সত্য। আধুনিক কবিতার উল্লিখিত কুশীলবদের মধ্যে এই নিবন্ধের উদ্দীষ্ট কবি আসাদ চৌধুরী (১৯৪৩-২০২৩)।
এই কবির মোট কবিতাগ্রন্থের সংখ্যা ১২। এগুলো হলো: তবক দেওয়া পান (১৯৭৫), বিত্ত নাই বেসাত নাই (১৯৭৬), প্রশ্ন নেই উত্তরে পাহাড় (১৯৭৯), জলের মধ্যে লেখাজোখা (১৯৮২), যে পারে পারুক (১৯৮৩), মধ্যমাঠ থেকে (১৯৮৪), মেঘের জুলুম, পাখির জুলুম (১৯৮৫), দুঃখীরা গল্প করে (১৯৮৭), নদীও বিবস্ত্র হয় (১৯৯২), বৃষ্টির সংসারে আমি কেউ নই (১৯৯৮), কিছু ফুল আমি নিভিয়ে দিয়েছি (২০০৩) ও ঘরে ফেরা সোজা নয় (২০০৬)। আসাদ চৌধুরীর কবিতায় সমাজের নিম্নশ্রেণী থেকে মধ্যবিত্ত ও উচ্চবিত্তের ক্ষুধা-দারিদ্র্য-অসহায়ত্ব-একাকিত্ব-দর্শন-আধ্যত্মচিন্তা বিপুলভাবে উপস্থিত। এছাড়া গ্রামীণ পটভূমি থেকে শুরু করে নাগরিক জীবনের প্রতিচিত্রও কবিতার শরীর আত্মা গঠন করেছেন তিনি। এই কাজে তিনি সমাজের ব্রাত্যশ্রেণী, বিশেষত ভদ্রসমাজে অবহেলিত-অনুচ্চারিত শ্রেণীর প্রতিও আসাদ চৌধুরীর আন্তরিকতা লক্ষণীয়। এই প্রসঙ্গে সরদার আবদুস সাত্তারের উক্তি প্রণিধানযোগ্য। তাঁর মতে,
‘প্রপীড়িত মানুষের জন্য ভালোবাসার সুপ্ত বীজ তিনি অন্তরে লালন করেছিলেন বাল্যকাল থেকেই। তাই স্কুলের ছাত্র থাকাকালীন সময়ে তাঁর প্রথম কবিতাটিতে পতিতা বলে কথিত সমাজের ব্রাত্য রমনীদের প্রতি অকুণ্ঠ সমবেদনার প্রগাঢ় প্রকাশ লক্ষ করা যায়।’ (লেখক পরিচিতি)১
আসাদ চৌধুরীর কবিতাগ্রন্থের সংখ্যা ১২ হলেও প্রথম তিনটি গ্রন্থ—তবক দেওয়া পান, বিত্ত নাই বেসাত নাই ও প্রশ্ন নেই উত্তরে পাহাড়-ই সমধিক পরিচিত। বিশেষত আসাদ চৌধুরীর নাম উচ্চারিত হওয়ার সঙ্গে সঙেঙ্গ তবক দেওয়া পান কবিতাগ্রন্থটির নামের পাশাপাশি একটি চিত্রকল্প মানসপটে ভেসে ওঠে। এরপরই বাকি দুটি কবিতাগ্রন্থের নাম মনে আসে খুব দ্রুত। এরপরই বাকি নয়টি কবিতাগ্রন্থের নাম আসে প্রাসঙ্গিকভাবেই। এসব কবিতাগ্রন্থে কবির জীবনাভিজ্ঞতা, কল্পনা, পরিবেশ, সমাজ, দেশপ্রেম, আধ্যাত্মসংকট, একাকিত্ব, আশা-হতাশা, ভালোবাসা-বিরহ, চিন্তা, প্রজ্ঞা ও মনীষার ছাপ রয়েছে। তাঁর কবিতার প্রধান প্রবণতা মোটা দামে ৫টি। এগুলো হলো:
ক. ব্যক্তি থেকে সমষ্টির জীবন-সংগ্রাম
খ. পরিবার থেকে রাষ্ট্রের সংকট ও মানুষের ভূমিকা
গ. বিশ্বাস-অবিশ্বাসের দ্বন্দ্ব
ঘ. আঙ্গিক-প্রকরণে সচেতনতা
ঙ. গ্রামীণ ও নগর জীবনের যুগ্মছবির চিত্রায়ণ
উল্লিখিত প্রবণতাগুলো একইসঙ্গে একটি কবিতায় পাওয়া যাবে না। কোনো কবিতায় একটি কী দুটি প্রবণতার প্রমাণ মিলবে।
তাঁর কবিতায় শৈশব-কৈশোরের স্মৃতিচারণের ছলে পরিবার ও বাবা-মায়ের প্রসঙ্গও আসে। তিনি জীবনকে দেখেছেন সংঘর্ষের ভেতর, সংগ্রামের ভেতর। আবার স্নেহমমতার ভেতরও জীবনকে আবিষ্কার করেছেন। তিনি একইসঙ্গে স্রষ্টা ও দ্রষ্টার ভূমিকা পালন করেছেন। নিজে কল্যাণকামী সমাজ গঠনের স্বপ্ন দেখেছেন, সেই স্বপ্নে অন্যকেও প্রাণিত করেছেন। এখানে বিশেষভাবে ‘আমার বাবা’ ও ‘স্বীকারোক্তি’ কবিতা দুটির প্রসঙ্গে উল্লেখ করতে হয়।
ক.
আমার বাবা বাসতো ভালো আমাকে
আমার ময়লা জামাকে
শোনো বলি চুপি চুপি
আমার উলের রঙিন টুপি
দিতো মাথায় ফাঁক পেলেই
হাসতো তখন দাঁত মেলেই।
(আমার বাবা)২
খ.
উল্টোভাবে রোপণ করা বৃক্ষ সে কি
আমার দেহ, আমার শরীর?
অনুমতির অনুরোদে দেয়নি টোকা আমার ঘরে
দেয়নি টোকা আম্মা কিংবা
স্বর্গীয় সেই বিরাট পুরুষ, লোকপ্রিয় জনক আমার।
(স্বীকারোক্তি)৩
প্রথম কবিতায় বাবার সন্তান্য বাৎসল্য কতটা অকৃত্রিম, তার চিত্র এঁকেছেন আসাদ চৌধুরী। বলেছেন, ‘আমার বাবা বাসতে ভালো আমাকে/ আমার ময়লা জামাকে’। সন্তানের প্রতি বাবার এমন অকৃত্রিম ভালোবাসা-স্নেহমমতার কথা সাধারণত কবি-কথাশিল্পীরা প্রকাশ করেন না। জগতের সিংহভাগ শিল্পী-সাহিত্যিকই মায়ের মমতার কথা নানাভাবে, নানাভঙ্গিতে সহস্র কণ্ঠে উচ্চারণ করলেও বাবার নিঃস্বার্থ ভালোবাসা ও স্নেহের কথা বলেন না। আসাদ চৌধুরী চিরায়ত প্রথার বিপরীতে দাঁড়িয়েছেন।
দুটি কবিতায় বিষয়ের মিলের পাশাপাশি আঙ্গিক ও প্রকরণগত মিলও রয়েছে। বিষয়গত দিকে যেমন কবিতা দুটিতে শৈশব-কৈশোর, পরিবার, বাবা-মায়ের প্রসঙ্গে রয়েছে, তেমনি রয়েছে স্মৃতিরোমন্থন ও প্রকৃতির রূপায়ণও। আবার আঙ্গিকগত দিক থেকেও কবিতা দুটি যেমন অসম পর্বে রচিত। তবে, প্রথমটি অন্ত্যমিলযুক্ত হলেও দ্বিতীয়টি অমিল চরণে গঠিত। মিল-অমিলের অমিলটুকু বাদ দিলে উভয় কবিতায় ভাবগত ও ধ্বনিগত মিলের পাশাপাশি কালগত সামঞ্জস্যও ফুটে উঠেছে।
আসাদ চৌধুরী জীবনের রূঢ়রূপকে দেখেছেন সমাজের ভেতর থেকে। যাপিত জীবনের অন্তসলিলা প্রবাহের ভেতর দিয়ে। ফলে জীবনের প্রসন্ন রূপের পাশাপাশি দুঃখভারাক্রান্ত দৃশ্যও তাঁর মানসপটে প্রোজ্জ্বল হয়ে দেখা দিয়েছে। এ কারণে সুখ নিয়ে যেমন তিনি বিলাসিতা করেন না, তেমনি নিজেকের দুঃখবিলাসী ভাবতেও পছন্দ করেন না। বিষয়টি ধরা পড়েছে তাঁর ‘আত্মজীবন-ি২’ শিরোনামের কবিতায়।
তোদের আবার দুঃখ কেন, রাজার মতো?
দায়িত্ব নেই, যোগ্যতা নেই লড়াই করার,
ভান করেসিছ দিন রাত্তির সভ্য হবার
ঝুঁকি নেবার মুরোদও নেই, রাজার মতো
দুঃখ করিস, মিছিমিছি এ রোগ কেন?
আকাশ সমান উচ্চাকাক্সক্ষা বাড়তে থাকে
বুকের ভিতর অরণ্য তোর কেবল পাতা
পেশীর মতো দা বাঁকানো কাঁধ আছে তোর?
(আত্মজীবনী-২)৪
এই কবিতায় তিনি বলতে চেয়েছেন দুঃখী মানুষকে দুঃখ প্রকাশ করতে নেই। দুঃখবিলাসিতার মূলত রাজ-রাজড়ার কাজ। তাঁর অট্টালিকায় বাস করবে, আর ভোগবিলাসে মত্ত থাকবে। কিন্তু মানবকল্যাণে ব্যয়ের কথা শুনলে দুঃখী-দুঃখী একটা ভাব নিয়ে বিশ্বের সমস্ত অভাব অনটনের কথা শোনাবে। তাই আসাদ চৌধুরী বলছেন, সেই দুঃখবিলাসী ‘রাজার মতো’ ব্রাত্যজনকে দুঃখবিলাসিতা মানায় না। তাদের জীবনের সঙ্গে, বিশ্বের সঙ্গে, প্রাকৃতিক দুর্যোগের সঙ্গে, অত্যাচারী ক্ষমতাবানদের সঙ্গে প্রতিনিয়ত সংঘর্ষ করেই বেঁচে থাকতে হবে। নিজেদের অপ্রাপ্তি-কষ্টভোগের জন্য হা-হুতাশ করা যাবে না। যদি ‘আকাশ সমান উচ্চাকাক্সক্ষা বাড়তে থাকে’ এসব মানুষের তাহলে তাকে সংগ্রামী হতে হবে। সংগ্রাম ছাড়া, পরিশ্রম ছাড়া, দৃঢ় মনোবল ও কঠোর প্রত্যয় ছাড়া স্বপ্ন পূরণ হওয়ার নয়। পুরো কবিতায় শ্লেষোক্তির মাধ্যমেই মানুষকে সংগ্রাম-সংঘর্ষের মন্ত্রপাঠ করিয়েছেন কবি।
আসাদ চৌধুরী হতাশাবাদী নন। তিনি আশাবাদী। স্বপ্ন দেখেন। স্বপ্ন দেখতে ভালোবাসেন। আগেই বলা হয়েছে, তিনি অন্যকেও স্বপ্ন দেখাতে পছন্দ করেন। এ প্রসঙ্গে কবি-প্রাবন্ধিক মামুন রশীদের উক্তি প্রণিধানযোগ্য। ‘আসাদ চৌধুরী’ শীর্ষক প্রবন্ধে তিনি বলেছেন.
আসাদ চৌধুরী সম্ভাবনার কথা বলেন, আশাবাদী হতে শেখান, অনুসন্ধানী হতে উৎসাহী করে তোলেন তার পাঠককে। তবে তিনি এড়িয়ে যাওয়ার মন্ত্রণা দেন না, বরং তার পরিণতিকে প্রকাশ করেন। ফলে তার কবিতা একান্তভাবে ব্যক্তিআশ্রয়ী হয়ে পড়ে না। ব্যক্তির বিবর্তনকে প্রাধান্য দিলেও তার কবিতায় মানুষের চেয়ে বড় হয়ে উঠেছে মানুষের বস্তুগত অবস্থান।৫
মানুষ যতই ইতিবাচক মানসিকতার হোক, তার ব্যক্তিগত অনেক দুঃখ এসে মাঝেমাঝে তাকেও ক্লান্ত করে। তাকেও মনে করিয়ে দেয় তার না-পাওয়ার কথা, হতাশার কথা। আর তখনই জীবনবাদী-আশাবাদী মানুষের বুকের ভেতর থেকে দলা পাকিয়ে পাকিয়ে দীর্ঘশ^াস বের হয়ে আসে। তীরের আঘাতে প্রতিপক্ষ কর্ণকে ধরাশায়ী করেও অর্জুন যেমন শেষ পর্যন্ত বুঝতে পারে, এই জয় প্রকৃত বীরের জয় নয়। ছলনার আশ্রয়ে নিরস্ত্রকে অস্ত্রের আঘাতে বধ করে যতটা জয় অর্জিত হয়েছে, তারও বেশি নৈতিক পরাজয় ঘটেছে। সবচেয়ে বেশি ক্ষতি হয়েছে খোদ অর্জুনের, পরিচয় না জেনেই কেবল নিজের শ্রেষ্ঠত্ব প্রমাণের জন্য যে নিরস্ত্রকে অস্ত্রের আঘাতে ধরাশায়ী করা হয়েছে, সেই কর্ণ তারই অগ্রজ। আর তখনই তার সমস্ত জয় পর্যবসিত হলো পরাজয়ে। মানুষের জীবনেও এমন জয়ের আড়ালে পরাজয় লুকিয়ে থাকে। তেমনই একটি কবিতার শিরোনাম ‘আত্মজীবনী-৩’।
সুখের হাত ধরেছিলাম
হঠাৎ ছুটে গ্যালো—
তখন থেকে চেষ্টা তাকে
ধরার।
কান্না শুরু আমার।
দুখের হাত ধরেছিলাম
হঠাৎ ছুটে গ্যালো—
তখন থেকে চেষ্টা তাকে
ধরার
দুঃখ শুরু আমার।
(আত্মজীবনী-৩)৬
আাসাদ চৌধুরীর এই সুখ, কান্না ও দুঃখের পরম্পরা বর্ণনার ভেতর লুকিয়ে রয়েছে মানবজীবনের গূঢ়তম রহস্য। মানব-জাতির স্বভাবজাত বৈশিষ্ট্য কেবলই ছুটে চলা। কখনো সুনির্দিষ্ট লক্ষ্যের পেছনে, কখনো উদ্দেশ্যহীন। তাই জীবনে বৈচিত্র্য—জীবন এত বর্ণিল। বিষয়টি ধরা পড়েছে ‘স্বপ্নের সম্মোহন’ শিরোনামের আরও একটি কবিতায়।
কেটেছে সময় সন্ত্রাসে সংঘাতে
কুয়াশা কেটেছে রক্তের বন্যায়
মৃত্যু তবুও হালটে ও ফুটপাতে
মাথা উঁচু করে সহস্র অন্যায়
(স্বপ্নের সম্মোহন)৭
আধুনিক কালের কবিতার প্রধান বৈশিষ্ট্য বস্তুবাদীচেতনা। মানুষ ধর্মে নিঃশর্ত সমর্পণের পথ থেকেই অনেকটাই সরে এসেছে। একইসঙ্গে অন্ধবিশ্বাস, কুসংস্কার ও ভাববাদের জগৎকেও ধীরে ধীরে মানুষ বিদায় জানিয়ে আসছে। কবিরাও এর ব্যতিক্রম নয়। তাঁরাও বিজ্ঞানে-যুক্তিতে-প্রগতিতে মনোযোগী হয়ে উঠেছেন। কারণ,
উনবিংশ শতাব্দীতে জড়বাদী ও যুক্তিবাদী বিজ্ঞান ধর্মের স্থান অধিকার করেছিল এবং মানুষের সমাজ ও তার মূল্যবোধকে একটি ঐক্যসূত্রে ধ’রে রেখেছিল। কিন্তু এই শতকের অন্তিমে ও বিংশ শতকের প্রথম দশকে কতকগুলি যুগান্তকারী বৈজ্ঞানিক আবিষ্কার মানুষের মানসজগতে এক বৈপ্লবিক পরিবর্তন ঘটালো।৮
কিন্তু জড়বাদী ও যুক্তিবাদী বিজ্ঞানের উন্নতির সঙ্গে তাল মিলিয়ে মানুষের ততটা আত্মিক উন্নয়ন ঘটেনি। মানুষে মানুষে ভেদাভেদ বেড়েছে। অন্ধবিশ্বাসকে মানুষ যেমন ত্যাগ করা শুরু করেছে, তেমনি মানুষের প্রতি মানুষের বিশ্বাসও আস্তে আস্তে কমতে শুরু করেছে। শিল্পকলার সঙ্গে যুক্ত সৃজনশীল ব্যক্তিদের বিষয়টি মর্মাহত করেছে, সন্দেহ নেই। এর মধ্যে কবিদের হৃদয়ে আঘাতটা বেশি পরিমাণের লেগেছে। আসাদ চৌধুরীর কবিতায় বিষয়টি ধরা পড়েছে এভাবে,
নদীর জলে আগুন ছিলো
আগুন ছিল বৃষ্টিতে
আগুন ছিলো বীরাঙ্গনার
উদাস করা দৃষ্টিতে।
…
দূরের শোনা গল্প—
তখন সত্যি মানুষ ছিলাম
এখন আছি অল্প।
(তখন সত্যি মানুষ ছিলাম)৯
জড়বাদী বিজ্ঞানের সঙ্গে ভাববাদী হৃদয়ের মিলনের চেয়ে কখনো কখনো সংঘর্ষই বড় হয়ে ওঠে। কারণ, মানুষ বস্তুর গুণাগুণের প্রমাণ পরীক্ষার মাধ্যমেই পায়। সেই প্রমাণ হাতে-নাতে পায় বলে তার গুরুত্ব ব্যক্তির কাছে কম। কারণ সেখানে রহস্য নেই। সত্যমিথ্যার গুরুত্ব নিয়ে দার্শনিক সংলাপ নেই। দার্শনিক যুক্তিপ্রয়োগের স্থানও নেই। কিন্তু হৃদয় সবসময় প্রমাণ দাবি করে না। হৃদয় কখনো কখনো কল্পনাবিলাসিতাকেই বেশি গুরুত্ব দেয়। এই ক্ষেত্রে একেক মানুষের হৃদয়ে একেক ধরনের বাঁশি সুর তোলে। একেক ধরনের মানুষের কল্পনা একেক রকমের হয়ে থাকে। সেই মানুষদের প্রত্যেকের কল্পনাই স্বতন্ত্র। কারও সঙ্গে কারও কল্পনার বিন্দু মাত্র মিলও থাকে না। কেননা,
মানুষ কল্পনায় সবসময়েই মৌলিক—প্রত্যেক মানুষই স্বতন্ত্র কল্পনাশক্তির অধিকারী। সৃজনশীতার অঞ্চলে এই তথ্য আরও বেশি সত্য—বিশেষত কবির কল্পনা। মানুষ নির্বিশেষ জ্ঞানের অধিকারী হতে পারে—একজনের পাঠলব্ধ ধারণা ও জীবনাভিজ্ঞতার সঙ্গে অন্যজনের সাদৃশ্য খুঁজে পাওয়া যেতে পারে। কিন্তু এমন দুজন মানুষ পাওয়া যাবে না—যাঁরা অবিকল একই স্বপ্ন দেখেন এবং একই ধরনের কল্পনার অধিকারী। কবিদের ক্ষেত্রে এই কথাগুলো শতভাগ খাঁটি।১০
কল্পনার এই মৌলিকত্ব নিয়ে মানুষ নিজেকে সুখী করতে চায়। কিন্তু পারে না। পারে না, তার কারণও স্পষ্ট। মানুষ মাত্রই সময়ের ক্রীড়নক। সময়ই সবচেয়ে বড় নিয়ামক। বিষয়টি ধরা পড়েছে সমিল অক্ষরবৃত্তে রচিত ‘সময়’ শীর্ষক কবিতায়। এই কবিতায় সময়কে আশ্রয় করে মানবজীবনের দীর্ঘ যাত্রার একটি সংক্ষিপ্ত চিত্র অঙ্কন করেছেন।
সময় রেখেছে ধ’রে বয়সের সকল স্মারক
মাঠের ফসল তোলে অপ্রসন্ন কৃষকেরা শোকে
হাজার বছর ধরে হেঁটে চলে ক্লান্ত পর্যটক
নূতন বৃক্ষের চারা মাটির গভীরে মাথা ঠোকে।
(সময়)১১
জীবন ও জগৎসংসারে ঘটনাপুঞ্জ কবিকে আলোড়িত করে। যে-সব ঘটনা সময়ের স্মারক হয়ে মানবমনে বিশেষ রেখাপাত করে, সেই সব ঘটনা ঐতিহাসিকরা ভবিষ্যতের জন্য লিপিবদ্ধ করেন, সমাজকর্মীরা তার বিশ্লেষণ করেন। তেমনি শিল্পীরাও কখনো রঙতুলিতে, কখনো শব্দে-বাক্যে প্রকাশ করেন। তেমন তিনটি কবিতার নাম ‘ইতিহাস’, ‘নিঃশব্দতাকে নিয়ে’ ও ‘কালো দ্বিখণ্ডিত জিভ’।
ক.
লোকটার দাঁতে তামাকে দাগ
পায়ের কাছেই গোটানো গেঞ্জি
এক মনে শুধু কবর খুঁড়ছে,
তার মুখের নেই শোকের চিহ্ন
সুখের চিহ্ন
তবুও লোকটা কবর খুঁড়ছে…
(ইতিহাস)১২
খ.
পুঁজি আমার হয়নি তো নিঃশেষ
ঠিক রেখেছি একটি শব্দ জেবে
ভেবে-চিন্তে ঠিক করেছি বেশ
সেই শব্দটি এই অকম্মাই দেবে।
…
(নিঃশব্দতাকে নিয়ে)১৩
গ.
একটা বিষাক্ত সাপ, এত অভিশাপ বোঝা যায়?
জিভের ভিতরে জ্বালা, দুঃস্বপ্ন এত যে দহন
অভিজ্ঞতা দিয়ে ক্রমে ক্রমে বুঝিতে পেরেছি।
(কালো দ্বিখণ্ডিত জিভ)১৪
প্রথম কবিতায় একজন গোরখোদকের পূর্বপুরুষ থেকে শুরু উত্তরপ্রজন্মের কর্মের বর্ণনা দেওয়া হয়েছে। এতে বলা হয়েছে, লোকটির বাবা কবর খুঁড়তো, লোকটি কবর খুঁড়চে। আর ভবিষ্যতে তার সন্তানও কবর খুঁড়বে। অর্থাৎ যে কেবল উত্তরাধিকার-সূত্রেপ্রাপ্ত কর্মকে আঁকড়ে ধরে, তার পক্ষে নতুন কর্মের সন্ধান করা সম্ভব নয়। মানুষ যতক্ষণ পর্যন্ত নতুন পরিকল্পনা করতে না শেখে, ততক্ষণ পর্যন্ত পুরনো জরাজীর্ণ কর্মই তার কাঁধে চেপে বসে থাকে। দ্বিতীয় কবিতা ‘নিঃশব্দতাকে নিয়ে’তে কবি দেখিয়েছেন নৈঃশব্দ্যকে ধরার সমস্ত আয়োজন তার ব্যর্থ। কিন্তু ব্যক্তির সাধনা চলমান। মানুষ মাত্রই ছলনা ও মোহের কাছে পরাজিত হতে বাধ্য। জীবনে অন্তত একবার হলেও মানুষ ছলনা ও মোহের জালে আটকে যায়। সেই সত্যই ‘কালো দিখণ্ডিত জিভ’ কবিতায় চিত্রিত করা হয়েছে।
তবে এসব ব্যাখ্যার কোনোটাই চূড়ান্ত নয়। কারণ উল্লিখিত কবিতাগুলো পাঠে সোজাসুজি কোনো অর্থ আবিষ্কার আপাতত সম্ভব নয়। এর কারণ, সাধারণত কবিতা কখনোই একার্থক হয় না। অনেকার্থ নিয়েই কবিতার অবয়ব ও অন্তরাত্মা গঠিত হয়। এ কারণে কবিতার অর্থ বোঝার চেয়ে অনুভবের দিকেই পাঠককে বেশি জোর দিতে হয়। যত বেশি অনুভব সম্ভব, ততই রসগ্রহণও সহজ। পাঠকের কাজ কবিতা থেকে রসগ্রহণ; যত রসগ্রহণ ততই চিত্ত প্রসন্ন। এর কারণও আছে,
একটি কবিতা পুনঃপুনঃ পাঠে যা পাওয়া যায়, তার পুরোটা ব্যাখ্যা করা যায় না। মনের নানা স্তরে নানা ধরনের প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করে বিশেষ-বিশেষ শ্রেণীর কবিতা। ফলে একই কবিতা স্থান-কালভেদে একই ব্যক্তির মনে একেক রকম অনুভূতির জন্ম দেয়। বিষয়টা যতটা রহস্যের, তারও বেশি বিস্ময়ের। (কবিতার সংকট)১৫
অনুভূতি, রহস্য ও বিস্ময়ের মধ্যে একটি সূক্ষ্ম সম্পর্ক নিহিত রয়েছে। তাই ওপরের উদাহরণের কবিতাংশগুলোর অর্থ একেকজনের কাছে একেক রকমভাবে ধরা দেয়। আর এটাই কবিতার গূঢ় রহস্য।
আসাদ চৌধুরী জীবনকে যেভাবে দেখেছেন, সেভাবেই তার চিত্র অঙ্কন করেছেন। তাই তাঁর কবিতায় মানুষের ধর্মবিশ্বাস, আচরণ, কর্ম, দর্শন, রাজনীতি, সংস্কৃতি ও প্রথাকে অনুষঙ্গ করে তুলেছেন। আর এ কাজে তিনি সবসময় আশাবাদকে বড় করে দেখেছেন। তাই তাঁর কবিতা হয়ে উঠেছে আশাবাদী মানব-জীবনের দীক্ষা।