শনিবার , ২১শে ডিসেম্বর, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ

প্রবন্ধ

কী ভাবে সৃষ্টি হয় কবিতা -ভুবনেশ্বর মন্ডল

শাস্ত্রে কবিকে তুলনা করা হয়েছে জগৎ স্রষ্টা ব্রহ্মার সঙ্গে। ব্রহ্মার মত কবি ও সৃষ্টি কর্তা ,তিনি সৃষ্টি করেন কাব্য ভুবন। একক ব্রহ্ম আনন্দ লাভের জন্য বহুতে পরিণত হয়েছিলেন। তা থেকেই সৃষ্টি হয় বৈচিত্র্যময় জগত। এভাবেই অদ্বৈত দ্বৈত হয়ে যান । কবি ও নিজেকে খন্ড-বিখন্ড করে বৈচিত্র্যময় করে তোলেন কবিতার ভুবনে। কবি তাঁর কবিতার মধ্যে আস্বাদন করেন নিজের রূপ রস গন্ধ স্পর্শ কে। আসলে কবিতা কবি আত্মার প্রতিফলন।

প্রথমেই আসা যাক এই কথায় যে একজন কবি কবিতা লেখেন কেন। আসলে কবিতা বা সাহিত্য একজন স্রষ্টার মনোজগতের ফসল। দেশ, কাল,জীবন, কবির আত্মায় যে বিচিত্র অনুভব উপলব্ধি সৃষ্টি করে তাই প্রকাশ করেন কবি তাঁর কবিতায়। কিন্তু কেন সৃষ্টি করেন ?রবীন্দ্রনাথের মতে আনন্দ লাভের জন্য। রবীন্দ্রনাথ স্পষ্টই বলেছেন সাহিত্য সৃষ্টির কোন উদ্দেশ্য নেই, শুধু আনন্দ লাভের জন্যই একজন স্রষ্টা সাহিত্য সৃষ্টি করেন। যারা “হিতবাদী “তাঁরা বলেন সমাজের হিত সাধনের জন্যই সাহিত্য রচনা। মার্কসবাদীরা বলেন সাহিত্যের উদ্দেশ্য হল সমাজ পরিবর্তন করা। সাহিত্য সমাজ পরিবর্তনের হাতিয়ার। দ্বান্দ্বিক বস্তুবাদকে আশ্রয় করে শ্রেণী সংগ্রামের চিত্রটি তুলে ধরাই সাহিত্যের কাজ। আর একজন মার্কসবাদী সাহিত্যিক কে তুলে ধরতে হবে সাম্যবাদী সমাজের চিত্র। সাহিত্য কোন দৈব প্রেরণা নয়, বরং সাহিত্যিক হলেন “একজন কলম পেষা মজুর ।”এই কথা বলেছেন মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় ।তাই মার্কসীয় ভাবনায় সাহিত্য সৃষ্টি উদ্দেশ্যমূলক।
এসবের নিরিখে কবিতা সৃষ্টির কারণটি ব্যাখ্যা করা যেতে পারে। একজন সচেতন, হৃদয়বান ,অনুভূতিশীল ও সংবেদনশীল সামাজিক মানুষ প্রতিটি মুহূর্তে দেখে, শুনে ,ঘটনার সঙ্গে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে জড়িত হয়ে যে অভিজ্ঞতা উপলব্ধি ও অনুভবে জারিত হন তা যখন ভাষার দেহে কল্পনাকে আশ্রয় করে সৃষ্টির অনিবার্য তাগিদে মুর্ত্ত হয়ে ওঠে তখন সৃষ্টি হয় একটি কবিতা। কবিতা সৃষ্টির নেপথ্যে থাকে একটি বিশেষ প্রেরণা। কোন ঘটনা অভিজ্ঞতা অনুভূতি দর্শন মনে যে ক্রিয়া প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করে তা থেকেই জন্ম নেয় কবিতার অঙ্কুর । মনোবিজ্ঞানী সিগমন্ডয়েড মনের তিনটি স্তর নির্দেশ করেছেন। এগুলি হলো চেতন অবচেতন এবং অচেতন স্তর। এই তিন স্তরে আমাদের প্রত্যক্ষ কিংবা পরোক্ষ বিভিন্ন অভিজ্ঞতার স্মৃতি সঞ্চিত থাকে। সেই সঙ্গে থাকে অনুভূতি কল্পনা ইত্যাদি। আমাদের মস্তিষ্ক ও মনের ক্রিয়ায় সৃষ্টি প্রক্রিয়া সংঘটিত হয়। আর এগুলি নেপথ্যে কাজ করে আমাদের স্নায়ূ, হরমোন, নানা জৈব রাসায়নিক পদার্থ, এবং মস্তিষ্কের কোটি কোটি কোষের বিচিত্র ক্রিয়া। আমাদের মনের মধ্যে যখন সৃষ্টি হচ্ছে একটি বিশেষ প্রেরণা এবং তা যখন প্রকাশের জন্য উন্মুখ তখন মস্তিষ্ক, স্নায়ূ ও মনের সম্মিলিত ক্রিয়ায় তৈরি হয় একটা অভ্যন্তরীণ নেটওয়ার্ক। এখানে আমাদের মনের তিনটি স্তর চেতন ,অবচেতন এবং অচেতন একটা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা গ্রহণ করে। এই অবস্থায় সৃষ্টিশীল মানুষের মধ্যে আসে একাগ্রতা, তন্ময়তা এবং এক ধ্যানস্থ অবস্থা । তখন চিন্তা চেতনা একটি বিশেষ বিন্দুতে নিবিষ্ট হয়ে যায়। সেটি তখন স্রষ্টার কাছে “পাখির চোখ। ” স্মৃতি ভান্ডারে সঞ্চিত ভাষা -কোষ থেকে ভাষা স্রোত বেরিয়ে আসে ফোয়ারার মতো। চেতন ,অবচেতন এবং অচেতন স্তরের ভাবনা গুলি প্রয়োজন অনুসারে ভাষা দেহকে আশ্রয় করে আত্মপ্রকাশ করে। বিষয় ,ভাব, কল্পনা, প্রকাশভঙ্গি ইত্যাদি অনুযায়ী কবির চেতনা কখনো বিচরণ করে বাস্তবে ,কখনো পরাবাস্তবে কখনো অধিবাস্তবে । এইসব বাস্তবতার স্তর অনুযায়ী কবিতার শ্রেণি বা জগত নির্ধারিত হয়ে যায় । শব্দগুলো অভিধা রূপে এলেও ওর শরীরে কবি সঞ্চারিত করেন লক্ষণা ও ব্যঞ্জনা কে। তবে ছন্দ অলংকার এসব দিয়ে যেখানে যেমন প্রয়োজন সে অনুযায়ী সাজিয়ে দেন কাব্য প্রতিমাকে। কবিতার বাক্যে কবি স্বতঃস্ফূর্ত ভাবাবেগে, কিম্বা পরিশীলিত ভাবাবেগে সৃষ্টি করেন ধ্বনি, রস, বক্রোক্তি। এভাবেই একজন কবি কাব্যের আত্মা সৃষ্টি করেন ।
কবিতা সৃষ্টির মুহূর্তে যেমন থাকে ভাব তন্ময়তা কিম্বা ধ্যান তন্ময়তা, তেমনি সৃষ্টির পর কবি যখন সেই কবিতা আস্বাদন করেন তখন কবি মনে জাগে এক মুগ্ধতার বিস্ময় রস । সমগ্র সৃষ্টি প্রক্রিয়াটি কীভাবে যে ঘটে গেল তা কবির অগোচরেই থেকে যায়। ঠিক এই জায়গা থেকেই মনে হতে পারে কবিতা সৃষ্টি যেন এক “দৈব প্রেরণা”। রবীন্দ্রনাথ তো তার ” জীবনদেবতা”কে নিয়ে নানা কথা বলেছেন। কবির মনে হয়েছে এই “জীবনদেবতা” ই বোধ হয় কবিকে অলক্ষ্যে থেকে সারা জীবন ভর চালনা করেছেন । অন্তরে বসে ভাষা যুগিয়েছেন । বুদ্ধদেব বসু তার “পান্ডুলিপি” কবিতায় বলছেন একটা কবিতা লিখে নিজেকে মনে হয়েছিল “দেবতার মত ।”তবে সময়ের অগ্রগতিতে কবিতার সৃষ্টি রাজ্যে কিছু কিছু সংযোজন ও বিয়োজন ঘটেছে। যেমন অতিরিক্ত আবেগ বর্জন, একই বিষয়ের পুনরুক্তি বর্জন, শব্দ প্রয়োগে সাবধানতা, চেনা ও প্রচলিত শব্দকেই অন্যভাবে অন্যতর ব্যঞ্জনায় প্রকাশ করা, মেধাকে গুরুত্ব প্রদান, মনন ও পরিশীলন কে কবিতা সৃষ্টির অন্যতম অঙ্গ হিসাবে স্থান প্রদান । প্রয়োজনে অপ্রচলিত শব্দগুলিকে তুলে আনা। কবিতাকে সমসাময়িক জীবনযাত্রার সঙ্গে সম্পৃক্ত করা। শব্দ প্রয়োগে ছুঁত মার্গ ত্যাগ করা । প্রকাশভঙ্গিতে অভিনবত্ব আনা। প্রভৃতি বিষয়গুলি নানাভাবে কবিতা সৃষ্টির সঙ্গে যুক্ত হয়ে আছে । বিশ্বজুড়ে কবিতা নিয়ে যে পরীক্ষা-নিরীক্ষা চলছে বা বিভিন্ন আন্দোলন হয়েছে বা চলছে, সেগুলিও প্রভাব ফেলছে কবিতা সৃষ্টির প্রক্রিয়ার উপর ।

ভুবনেশ্বর মন্ডল
সাঁইথিয়া লেবু বাগান
পোস্ট- সাঁইথিয়া
জেলা-বীরভূম


আরও