শনিবার , ২১শে ডিসেম্বর, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ

প্রবন্ধ

ছবি সম্পাদনা বনাম পোস্টমর্টেম -সুদীপ্ত সালাম

বাংলা পত্রিকার তিনজন ফটো এডিটরকে আমি চিনি বা চিনতাম, যারা দাবি করেন, তারা বাংলাদেশের প্রথম ফটো এডিটর। এক্ষেত্রে কেউ কাউকে ছাড় দেন না। এই দ্বন্দ্ব একসময় তুঙ্গে ছিল। আমি নিশ্চিত এখনো এ প্রসঙ্গে কথা উঠলে মাঠ আবার গরম হয়ে উঠবে। তাদের প্রতি শ্রদ্ধা রেখেই বলছি, ফটো এডিটরের দায়িত্ব, বার্তা কক্ষে তার সংগ্রাম এবং ফটো এডিটরের নৈতিকতা ও যোগ্যতা নিয়ে কোনো একাডেমিক আলোচনা আমি তাদের কাছ থেকে পাইনি। তারা বাজান একই ভাঙা রেডিও, ‘আমিই বাংলাদেশের প্রথম ফটো এডিটর’।
বাংলাদেশের জন্মের পর থেকে এখন পর্যন্ত সর্বসাকুল্যে ১০ জন হবেন যারা পত্রপত্রিকায় ফটো এডিটর হিসেবে নিযুক্ত হতে পেরেছেন। আমি মনে করি, এই পদটি যে আজো সমৃদ্ধ এবং পত্রিকার জন্য গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠতে পারলো না তার দায় বিগত ফটো এডিটরদের ওপরও কিছুটা বর্তায়। কেননা তাদের কেউই এই পদটিকে একটি প্রাতিষ্ঠানিক ও বুদ্ধিবৃত্তিক কাঠামো দেয়ার চেষ্টা করেননি। নামে ফটো এডিটর হলেও তারা আসলে পত্রিকার সম্পাদক ও বার্তা সম্পাদকদের হুকুমই তামিল করেন। এখানে ফটো এডিটর আলাদা বলিষ্ঠ সত্ত্বা নিয়ে কখনো দাঁড়ায়নি। অনেক ফটো এডিটরকে দেখেছি আদতে প্রধান ফটোসাংবাদিকের ভূমিকা পালন করতে। তার কাজ শুধু সম্পাদক, প্রধান বার্তা সম্পাদক, প্রধান প্রতিবেদক, সহসম্পাদক—এমনকি প্রতিবেদকের চাহিদা অনুযায়ী ছবি সরবরাহ করা।

আমাদের দেশে পত্রিকার কোন পাতায় কোন ছবি ছাপা হবে, কেন ছাপা হবে এবং কিভাবে ছাপা হবে তার সিদ্ধান্ত নেন বা নিতে চান বার্তা সম্পাদকেরা। এই কাজটিকে তারা অধিকার মনে করেন। পত্রিকার একটি বিরাট অংশ জুড়ে থাকে ছবি। স্কেল দিয়ে মাপলে দেখা যাবে পুরো পত্রিকার প্রায় ৩০ থেকে ৪০ শতাংশ ছবির দখলে। পত্রিকার এই যে শত শত ইঞ্চি জমিন, তার মালিক হবেন একজন এমন ব্যক্তি যিনি সরাসরি বার্তা বিভাগের কেউ না (অনেক বার্তা সম্পাদক তাই মনে করেন)—মানে ফটো এডিটর, তা মেনে নিতে পারেন না সম্পাদকের গাঘেষে থাকা প্রতাপশালী বার্তা সম্পাদকেরা। অনেক সময় মেনে নেন, মনে নেন না। জান দেবেন কিন্তু ফটো এডিটরের কর্তৃত্ব মেনে নেয়া হবে না। বার্তা সম্পাদকদের অচলায়তন ভেঙে ফটো এডিটরের স্বাধীনভাবে কাজ করা প্রায় অসম্ভব।

ফটোগ্রাফি সবাই করে। কেন করে? ভালো লাগে বলে, ভালো লাগে কেন? কারণ তা সুন্দর হয়। সবাই নিজের তোলা ছবিটিকে সুন্দর মনে করে। যিনি ছবি তুলেন তিনি এই সুন্দরের প্রেমে পড়ে যান, আসলে নিজেই নিজের প্রেমে পড়ে যান, গ্রিক পুরাণের সেই নার্সিসাসের মতো। এই আত্মমগ্নতা থেকে বের হতে চাই ‘ভিজুয়াল লিটারেসি’ বা দৃশ্যজ্ঞান, ফটো এডিটর, কিউরেটর বা একজন দক্ষ আলোচিত্রীর যা থাকে বা থাকতে হয়। আমাদের এখানে বার্তা সম্পাদকেরা মনে করেন, ফটো এডিটরের চেয়ে তাদের ‘ভিজুয়াল লিটারেসি’ কম না। পত্রিকায় বার্তা সম্পাদকদের দল ভারি থাকে। বার্তা সম্পাদক বলেন, ‘আমি কি কম বুঝি?’ দলের লোকজন সমস্বরে বলে, ‘আলবৎ না! আলবৎ না!’ রবীন্দ্রনাথের কবিতায় আছে, ‘বাবু যত বলে পারিষদ -দলে বলে তার শতগুণ।’ সুতরাং বাবু ওরফে বার্তা সম্পাদকের আত্মবিশ্বাস চরম পর্যায়ে পৌঁছে যায়। ফটো এডিটর বেচারা একঘরে হয়ে পড়ে। তখন সে চাকরি ছাড়ে অথবা তার চাকরি যায়। অনেকে অবশ্য তৃতীয় একটি পথ বেছে নেন, বার্তা কক্ষে বার্তা সম্পাদকের তালে ভরতনাট্যম করার কলা আয়ত্ব করে ফেলেন।

দেশের পত্রিকাগুলোতে আলোকচিত্রকে এখনো লেখার অলংকরণ হিসেবে দেখা হয়। পুরুষ শাসিত সমাজে যেমন মনে করা হয়, স্বামী ছাড়া স্ত্রীর মর্যাদা নেই, তেমনি পত্রিকাতে মনে করা হয়, লেখা ছাড়া ছবির কোনো মূল্য নেই। ছবি লেখার সহযোগী মাত্র! এখানে এটি দীর্ঘদিনের চর্চা, পরম্পরা। ছাপার সময় লেখার একটি চুলও বাঁকা হবে না, ছবির ওপর কাঁচি চলবে, প্রয়োজনে ছবিকে মেরে ফেলা হবে। ছবির শ্বাসরোধ করেও যাদের অনুশোচনা নেই তারাই এই বাংলার সম্পাদক, বার্তা সম্পাদক।

দুঃখজনক হলেও সত্য, ভিজুয়াল লিটারেসি যাদের নেই তারাই নিচ্ছেন আলোকচিত্রবিষয়ক সিদ্ধান্ত। একজন ফটো এডিটর যদি কোনো প্রতিবেদন নিয়ে প্রশ্ন তুলেন, তাহলে বলা হবে, ‘আপনি ছবির মানুষ, ছবি নিয়ে থাকুন, আমাদের সবক দিতে আসবেন না।’ কিন্তু প্রতিবেদনের মানুষ ছবির পোস্টমর্টেম করতে পারবেন! ছবি ছাপা না ছাপার একচেটিয়া সিদ্ধান্ত নিতে পারবেন! তা পত্রিকায় জায়েজ! ফরিদপুরে একটি প্রবাদ আছে, ‘অ-রাঁধুনির হাতে পইড়া রুই মাছ কাঁদে/ না জানি রাঁধুনি আমার কেমন করে রাঁধে।’ ভিজুয়াল লিটারেসিশূন্য ব্যক্তির হাতে পড়ে আলোকচিত্রও ওই মাছের মতো কাঁদে।

 

সুদীপ্ত সালাম : লেখক, দৃশ্যগল্পকার ও সাংবাদিক

 


আরও