শুক্রবার , ১০ই অক্টোবর, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ

সাক্ষাৎকার

কবি আল মাহমুদের আলাপচারিতা

আল মাহমুদ আধুনিক বাংলা সাহিত্যের একজন প্রধান কবি। কবিতা ছাড়াও তিনি উপন্যাস, ছোটগল্প ও শিশুসাহিত্যে বিশেষত্ব অর্জন করেছেন। ১৯৩০-এর দশকের কবিদের হাতে বাংলা কবিতায় যে আধুনিকতার উন্মেষ ঘটেছিল, তার সোনালি ফসল আল মাহমুদ বিংশ শতাব্দীর মধ্যভাগ থেকে ফলিয়ে চলেছেন। তবে তা ইউরোপীয় বন্দরের দিকে না তাকিয়ে, বাংলার লোকজ জীবনের দিকে চোখ রেখে। তিনি জন্মেছেন ১৯৩৬ সালের ১১ জুলাই, ব্রাহ্মণবাড়িয়ার মোড়াইল গ্রামে। আজ তার জন্মদিন উপলক্ষে ২০১৪ সালের মে মাসের প্রথম সপ্তাহে মগবাজারের বাসায় তার ব্যক্তিজীবন ও সাহিত্য নিয়ে আলাপচারিতার নির্বাচিত অংশ পুনর্মুদ্রণ করা হলো।

কবি আল মাহমুদের সাক্ষাৎকার

মোহাম্মদ সাদিক : মাহমুদ ভাই, আপনার শরীর কেমন আছে?
আল মাহমুদ : মোটামুটি ভালোই, তবে…
মোহাম্মদ সাদিক : গোল্ডলিফ সিগারেট যখন খান, তখন তো শরীর ভালোই আছে!
আল মাহমুদ : কথা হলো—বয়স হলো তো।
মোহাম্মদ সাদিক : কই, বয়স হলো আপনার?
শামীম রেজা : কোথায় বয়স হয়েছে? আপনাকে তো সেই তরুণই লাগছে!
মোহাম্মদ সাদিক : আপনার এই শার্টটা দেখে তো মনে হচ্ছে, আপনার মতোই তরুণ বয়সের নাসিরুদ্দিন (সম্পাদক: সওগাত) স্যারকে আমি একবার হাত ধরে সিঁড়ি দিয়ে নামানোর চেষ্টা করেছিলাম। উনি আমাকে বলেছিলেন, “তুমি আমার হাত ধরো কেন? আমি কি বুড়ো হয়ে গেছি?” আপনি তো সেই প্রজাতির লোক। আপনি তো কখনো বুড়ো হতে পারেন না।

শামীম রেজা : আপনি ‘যেভাবে বেড়ে উঠি’ লিখেছিলেন। তারপরে ওরকম আত্মজৈবনিক লেখা, যেমন ‘আমি ও আমরা’-এর মতো টুকরো টুকরো অনেক পেয়েছি। ওরকম কোনো পূর্ণাঙ্গ আত্মজৈবনিক লেখা এর পরে লিখেছেন?
আল মাহমুদ : একটা লেখা বোধহয় লিখেছিলাম—‘বিচূর্ণ আয়নায় কবির মুখ’।
শামীম রেজা : হ্যাঁ। কিন্তু তাতে আত্মজীবনীর কথা ওরকমভাবে আসেনি।

মোহাম্মদ সাদিক : আপনার মনে আছে বোধ করি, আশির দশকে ফরিদ কবির এবং আমি আপনার কাছে আসতাম। আপনার পঞ্চাশ বছরের প্রেমের কবিতা, ছবি, আপনার হাতের লেখা—এগুলোও ছেপেছিলাম। তখন আপনি খুব উৎসাহ দিয়েছিলেন, তার আবার অনুবাদও বেরিয়েছিল।
আল মাহমুদ : হ্যাঁ।
মোহাম্মদ সাদিক : তখন বেশ সময় আমরা কাটিয়েছিলাম। আপনি বিশ্বসাহিত্যকেন্দ্রে একবার বলেছিলেন, “পঞ্চাশের দশকে যখন লিখতে শুরু করি, তখন বারো কিংবা তেরো নম্বরে ছিল আমার সিরিয়াল। বুঝতে পারছ, তোমাদের ওই শামসু মিয়া এক নম্বরে ছিল। যুদ্ধ যখন শুরু হলো, তখন দেখলাম একে একে সব বীরেরা ধরাশায়ী হয়ে গেছে। মঞ্চে রক্তাক্ত তরবারি হাতে দাঁড়িয়ে আছি আমি আর শামসুর রাহমান। কই, একটা দামি সিগারেট দাও দেখি”—মনে আছে? এখন আমাদের জানতে খুব ইচ্ছে করছে—এই প্রশ্নের আপনি সহস্রবার উত্তর দিয়েছেন—আপনি কেন কবিতা লেখেন? অন্য কিছু করলেন না কেন?
আল মাহমুদ : এটা তো খুব জটিল প্রশ্ন। এর কোনো সংজ্ঞা নেই। কারণ কবিতা যারা লেখে, তারা কিন্তু অল্প বয়স থেকেই এই ইচ্ছাটা ধারণ করে—”কবি হব”। আমারও এই রকম ইচ্ছা ছিল যে কবি হব।
মোহাম্মদ সাদিক : সেটা কোন বয়সে?
আল মাহমুদ : কথা হলো যে, কবির কাজ কী? এই প্রশ্নটা ওঠে যে, কবি কী করে? কবির কাজ হলো—আমার ধারণা—তার জাতিকে স্বপ্ন দেখানো। সুখের স্বপ্ন। মানে স্বপ্নের মধ্যে রাখা। এটা হলো কবির প্রধান কাজ। কম-বেশি এই কাজটিই আমি আমার জীবনে করে গেছি। এখন কথা হলো, আমাদের দেশে মূল্যায়নটা হয় ঠিকই, কিন্তু বিলম্বে হয়। আমি কবিতা লিখেছি এবং কবিতার পক্ষে বলেছি। এর একটা মূল্যায়ন আমি আশা করি।

মোহাম্মদ সাদিক : আপনি কি মনে করেন, আপনার মূল্যায়ন করতে এ জাতি দেরি করেছে?
আল মাহমুদ : সেটা ঠিক বলা যাবে না। কারণ প্রতিদিনই তো দেখছি, টিভিতে দেখছি, আমাকে নিয়ে কথাবার্তা হয়। কমবেশি কিন্তু হয়, এটা তো এক ধরনের…
মোহাম্মদ সাদিক : হ্যাঁ, আপনি যখন কবিতা দেন, তখন তো তা লিড কবিতা হিসেবেই সব সংকলনে যায়।

শামীম রেজা : কিন্তু আপনার কি কখনো মনে হয়নি—আপনি মূল্যায়নের কথা বলছেন—যে লেখাটা আপনি লিখতে চেয়েছেন, তা লিখতে পেরেছেন? বা এখনো লিখতে পারেননি, চেষ্টা করছেন?
আল মাহমুদ : প্রশ্নটা হলো…
মোহাম্মদ সাদিক : খুবই জটিল।
আল মাহমুদ : শুধু জটিলই না প্রশ্নটা, যিনি প্রশ্নটা করলেন…
শামীম রেজা : তুমি বলো।
আল মাহমুদ : তোমাকেই তুমি বললাম। প্রশ্নটার মধ্যে কিন্তু এটার জবাব লুকিয়ে আছে। আমি মনে করি যে, প্রথম জানতে হবে কবি কাকে বলে। কবি হলেন সেই ব্যক্তি, যিনি অন্যকে কিছু বলেন। যিনি নির্ভুল ও সত্য বলেন, যদিও আমরা কবিদের বলি তারা কল্পনার মধ্যে থাকে।
শামীম রেজা : সত্যদ্রষ্টা।
আল মাহমুদ : কিন্তু কবিরা কি সত্যিই শুধু স্বপ্নের মধ্যে, কল্পনার মধ্যে থাকে? না, কবিরা বাস্তবের মধ্যেও থাকে। বাস্তবের পথেও চলতে হয়, পড়ে যায় না। একটু জটিল হয়ে যায়, কিন্তু ইশারায় বোঝানো যাবে না।

মোহাম্মদ সাদিক : কবে, কখন, কোথায়, কার কবিতা পড়ে বা কোন আবেগময় মুহূর্তে আপনি ধরে নিলেন যে, কবিতাই আপনাকে লিখতে হবে? অথবা আপনি মনে করলেন, কবিতা ছাড়া আপনি নিজেকে প্রকাশ করতে পারছেন না। সেই লগ্নটা কবে?
আল মাহমুদ : আমি যখন নিচের ক্লাসে পড়ি, তখনই আমার মধ্যে এই বোধ সৃষ্টি হয় যে, আমি কবি হব। এটা কিন্তু হয়। আর এখন তো দেখছি লোকে আমাকে কবি বলে।

শামীম রেজা : আপনি লিখেছেন, আপনার দাদা মর্সিয়া সাহিত্য, জারি-সারি গান লিখতেন এবং গাইতেন। আপনি কি মনে করেন, জিনের ধারাবাহিকতার প্রভাব আপনার মধ্যে পড়েছে?
আল মাহমুদ : হতে পারে, হতে পারে। আমার দাদা খুব পণ্ডিত ব্যক্তি ছিলেন, অসাধারণ পড়াশোনাও ছিল।
শামীম রেজা : ফারসি সাহিত্যে?
আল মাহমুদ : ফারসি সাহিত্যে গভীর পড়াশোনা করতেন এবং এর মধ্য দিয়েই জীবন কাটিয়েছেন।
শামীম রেজা : দাদাকে দেখেছেন?
আল মাহমুদ : আবছা মনে পড়ে।
שামীম রেজা : তার কোনো পাণ্ডুলিপি বা কোনো লেখা?
আল মাহমুদ : সেটা তো আমি পাইনি।

মোহাম্মদ সাদিক : আপনি একটা কথা বলেছেন মাহমুদ ভাই, আপনাদের পরিবারে কাসিদাসহ বাংলা সাহিত্যও পঠন-পাঠন বা গাওয়া হতো। আপনার কি মনে পড়ে, কী ধরনের বা কোন পর্বের সাহিত্য—এটি কি কোনো মর্সিয়া সাহিত্য, পদাবলি বা মঙ্গলকাব্য? মানে বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের কোন ধারাটি প্রচলিত ছিল?
আল মাহমুদ : বাংলা সাহিত্যের শুরু হয়েছে তো…
শামীম রেজা : চর্যাপদ থেকে। তবে মধ্যযুগ থেকেই বৈষ্ণব পদাবলি, শ্রীকৃষ্ণকীর্তন…
আল মাহমুদ : চর্যাপদ থেকে।
মোহাম্মদ সাদিক : হ্যাঁ, আমরা চর্যাপদ থেকেই বলব। তারপর মধ্যযুগ থেকে ‘লাইলি-মজনু’, ‘বৈষ্ণব পদাবলি’, ‘মঙ্গলকাব্য’—এগুলো?
আল মাহমুদ : এরকম ভাষা ছিল— “সসুরা নিদ গেল বহুড়ী জাগঅ।/কানেট চোরে নিল কাগই মাগঅ॥”
মোহাম্মদ সাদিক : চর্যাপদ?
আল মাহমুদ : এটা হলো বাংলা ভাষার আদি রূপ।
শামীম রেজা : মর্সিয়া সাহিত্য নিয়ে কথা হচ্ছিল।
মোহাম্মদ সাদিক : আপনার পরিবারে কোন ধারাটা আপনি শুনেছেন? মর্সিয়া, জারি—কোন ধরনের?
আল মাহমুদ : সবগুলো মিলিয়ে।
মোহাম্মদ সাদিক : মুসলমান পরিবারে তখন যেরকম থাকে আর কি।
שামীম রেজা : মর্সিয়া সাহিত্যে কিন্তু শিয়া এবং সুন্নির একটা ব্যাপার দেখতে পাই। আপনার পরিবারের পূর্বপুরুষ কি শিয়া সম্প্রদায়ের ছিলেন?
আল মাহমুদ : না, জানা নেই। আমরা মধ্যপন্থী সুন্নি মুসলমান।

মোহাম্মদ সাদিক : আপনার কি মনে হয়, আপনি যদি কবিতা না লিখতেন, তাহলে বাংলা সাহিত্যের কী ক্ষতি হতো?
আল মাহমুদ : কোনোই ক্ষতি হতো না।
শামীম রেজা : এটা আপনি বলছেন, কিন্তু আমি আমার জায়গা থেকে বলছি যে…
মোহাম্মদ সাদিক : যাই হোক, আপনার কি মনে হয় না বাংলা সাহিত্যে আপনি এমন কোনো জায়গা সংযোজন করেছেন, যেটি অনুপস্থিত ছিল?
আল মাহমুদ : আমি একটু গীতিময়তার পক্ষে। সেজন্য আমি প্রেমের কবিতা পছন্দ করি এবং প্রেমের কবিতাই লিখেছি। সেটা অবশ্য সবসময় ঠিক থাকেনি। প্রেম, হৃদয়বৃত্তি, আত্মার আকুতি—এইসব মিলিয়েই যে রসবোধ তৈরি হয়, সেটাই…

মোহাম্মদ সাদিক : আপনাদের সময়ে তো জীবনানন্দ দাশ একজন আগ্রাসী কবি ছিলেন। আপনি কি তাঁর কাছ থেকে বেরিয়ে আসতে চেষ্টা করেছেন?
আল মাহমুদ : এটা বলা ঠিক না যে তিনি আগ্রাসী কবি ছিলেন। তাঁর প্রভাব অত্যন্ত বেশি ছিল। জীবনানন্দ দাশের প্রতিভার বিশেষ দিক হলো, যা আমাদের সঙ্গে তাঁর সম্পর্কের সেতুবন্ধন তৈরি করে, তা হলো তাঁর চিত্ররূপময়তা। তিনি যে উপমা দিতেন, তা সাথে সাথে আমাদের মনে ধারণক্ষম হয়ে যেত। কবি হিসেবে আমার বিশ্বাস, তিনি খুব বেশি ইংরেজি সাহিত্য থেকে অনুপ্রেরণা নিয়েছেন।

שামীম রেজা : কিন্তু মাহমুদ ভাই, ‘রূপসী বাংলা’য় কিন্তু আমরা ওই প্রবণতা ছাড়িয়ে আঞ্চলিকতা দিয়ে আন্তর্জাতিকতাকে ছুঁতে দেখি। সনেটের এই বইটি একটা আলাদা তর্ক। ধরুন, আপনি আপনার ‘সোনালী কাবিন’-এ চৌদ্দটি সনেট লিখেছেন, আর জীবনানন্দ ওখানে একাত্তরটি ছেপেছেন। ‘রূপসী বাংলা’ তো নাম ছিল না মূলত। আপনার এরপর ‘দ্বিতীয় ভাঙ্গন’-এ কিছু সনেট আছে। জীবনানন্দ যে কাজটা ‘রূপসী বাংলা’য় করলেন, সেখানে দেখি ইন্দ্রের রাজসভায় আমাদের বেহুলাকে নাচাচ্ছেন এবং বেহুলার পায়ের সঙ্গে বাংলার নদীমাতৃক রূপ তুলে ধরেছেন। এখানে কিন্তু ইউরোপের ছোঁয়া পাই না, শুধুমাত্র সনেটের গড়ন ছাড়া।

মোহাম্মদ সাদিক : কেন জীবনানন্দকে ইংরেজি সাহিত্যের দ্বারা প্রভাবিত বলা হয়েছে?
আল মাহমুদ : যে ভাষাতেই আপনি কবিতা পড়েন, কবিতার কিন্তু জাত বদল হয় না, ভাষা বদল হয়। কবিতা বুকের ভেতর আঙুল ঢুকিয়ে দেয়।
שামীম রেজা : আপনি যে ফারসি অনুবাদ সাহিত্যের কথা বলেন, এতে কি কবিতা হারায়?
আল মাহমুদ : বাদ তো হয়ই, কমিউনিকেশন তো লাগবে। আমি ব্যক্তিগতভাবে ইয়েটস-এর কবিতা পর্যন্ত পড়াশোনা করেছি। একসময় পড়তাম। দুটো মাত্র ভাষা জানতাম—বাংলা আর ইংরেজি। খুব যে ভালো ইংরেজি জানতাম তা নয়, তবে পড়তে স্বচ্ছন্দ বোধ করতাম। কবিতার সারাৎসার, সারমর্ম বর্ণনা করা তো কবির পক্ষে সম্ভব নয়। কবিতা পড়তে হয়, কবিকে জানতে হয় কবিতা কী। আপনার মন চাইল, আপনি কবিতার বই নিয়ে বিছানায় শুয়ে আস্তে আস্তে পড়লেন। এই যে কাজটা কবিতা করে, বাধ্য করে, টানে, একটা টান তৈরি করে—সব মিলিয়ে কবিতা হলো কবিদের কাজ। এতে থাকে কবির সততা, বুদ্ধিবৃত্তি; তিনি কিছু বলেন, অন্যরা শোনেন।

মোহাম্মদ সাদিক : তাহলে ‘রূপসী বাংলা’র কবি বলে যাঁকে চিহ্নিত করা হয়, তাঁরও মূল অনুপ্রেরণা ছিল ইংরেজি সাহিত্য—এটি আপনি উপলব্ধি করেছেন। যদি আমাদের বলতেন, তিরিশের কবিদের থেকে পঞ্চাশের কবিরা কীভাবে পৃথক হলেন?
আল মাহমুদ : পঞ্চাশের কবি হলাম আমরা। গোড়ার দিকে আমরা তিরিশের কবিদের খুব পছন্দ করতাম, আপন মনে করতাম। কিন্তু পঞ্চাশ দশকে আমরা বুঝতে পারলাম যে আধুনিক কবিতার ধারাটা বদলে ফেলতে হবে।
שামীম রেজা : জীবনানন্দ থেকে মুক্তি পেতে হবে?
আল মাহমুদ : আমরা এটা চেষ্টাও করেছিলাম। চেষ্টা করিনি তা নয়। তার প্রমাণ আমাদের কবিতা।
মোহাম্মদ সাদিক : ‘আমরা’ বলতে কারা কারা?
আল মাহমুদ : আমি, শামসুর রাহমান, শহীদ কাদরী, ফজল শাহাবুদ্দিনের নামও বলা যায়। আবু জাফর ওবায়দুল্লাহ অবশ্য খুব বেশি কাজ করেননি, তবে তাঁর নামও বলা যায়।
মোহাম্মদ সাদিক : আপনি কি পশ্চিমবঙ্গের কারো কথা বলবেন?
আল মাহমুদ : আমি পশ্চিমবঙ্গ খুব ভালো করে পড়েছি। খুব সূক্ষ্ম একটি বিষয়—আমাদের আর ওখানকার কবিদের মধ্যে ভাষাগত, উপমা, উৎপ্রেক্ষা, শব্দ—সবকিছু পৃথক; একেবারেই পৃথক নয়, তবে পৃথক।

שামীম রেজা : পশ্চিমবঙ্গে আপনার যারা বন্ধু ছিলেন?
মোহাম্মদ সাদিক : শক্তি চট্টোপাধ্যায় তো আপনার ভালো বন্ধু ছিলেন।
আল মাহমুদ : হ্যাঁ।
মোহাম্মদ সাদিক : তাঁর সাথে কখনো এসব নিয়ে কথা বলেছেন?
আল মাহমুদ : দুঃখের কথা বলতে হয়, আমার বন্ধু ছিলেন, তবে এসব মুহূর্ত নিয়ে কথা হয়নি। যে সময়ের কথা বলছেন, শক্তির মধ্যে তখন সেন্স অব প্রপোর্শন ছিল না। মদ্যপান করতে করতে এমন একটা পরিস্থিতি হয়ে গিয়েছিল যে, সে সবসময় কাঁপত।
שামীম রেজা : সেটা কি তার কবিতায় প্রভাব ফেলেছে?
আল মাহমুদ : না। এটা তার ব্যক্তিগত কিছু দোষ। মদ্যপান করে নিজেকে নষ্ট করে দিল। কিছুদিনের মধ্যেই মরে গেল।
মোহাম্মদ সাদিক : কিন্তু মদ্যপান না করেও তো যে কোনো সময় কবি মরতে পারেন। কবিতার জন্য তো তিনি নিবেদিতপ্রাণ ছিলেন। আপনার কী মনে হয়?
আল মাহমুদ : এটা তো আপনি বলছেন। কিন্তু তিনি একজন মানুষ। অতিরিক্ত মদ্যপান এবং বিশৃঙ্খল জীবনের জন্য এত বড় একজন কবি শেষ হয়ে গেল। আপনি শক্তির কবিতা বের করে দেখুন, সংখ্যায় খুব অল্প। একজন মেজর পয়েট যাকে বলি, তাঁর কাজ তো পরিপূর্ণ থাকতে হবে।
মোহাম্মদ সাদিক : কিন্তু পৃথিবীর অনেক বড় কবিই তো সুশৃঙ্খল জীবনযাপন করতে পারেননি। আপনি শক্তি চট্টোপাধ্যায়ের কাছে তা আশা করছেন কেন?
আল মাহমুদ : শক্তির তো প্রতিশ্রুতি ছিল।
মোহাম্মদ সাদিক : মাইকেল মধুসূদন দত্তেরও তো প্রতিশ্রুতি ছিল। মাত্র আটচল্লিশ বছর বয়সে মারা গেলেন।
আল মাহমুদ : অনেক তর্ক এসে যাবে। ইংরেজি শিক্ষিত ভদ্ররা বলেন—মাইকেল মধুসূদন দত্ত। আপনি বলুন তো, মাইকেল কখনো নিজেকে মাইকেল বলে পরিচয় দিয়েছিলেন?
মোহাম্মদ সাদিক : নাম তো নিয়েছিলেন।
আল মাহমুদ : শ্রী মধুসূদন দত্ত বলতেন। মাইকেল দত্ত বলতেন। (সম্ভবত হবে—’মাইকেল মধুসূদন দত্ত বলতেন না’- জা. সো.)

שামীম রেজা : পঞ্চাশ দশক নিয়ে কথা হচ্ছিল। শক্তি আপনার বন্ধু। কখনো শঙ্খ ঘোষ, বিনয় মজুমদার, সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়—এদের সাথে আপনার সম্পর্ক হয়েছিল কি না? বা এদের কবিতা আপনার ভালো লাগে কি না?
আল মাহমুদ : এরা তো আমার সমসাময়িক বন্ধু ছিল। কবিতা তো এখন মনে নেই, নিত্য পড়ি না। তবে এরা খুব কাছের ছিল।
שামীম রেজা : শক্তি বাদে এদের মধ্যে কার কবিতা ভালো লাগত আপনার?
আল মাহমুদ : আমার শক্তিকেই ভালো লাগত।
שামীম রেজা : শক্তি কিন্তু আপনার কথাই বলত—‘মাহমুদ আর আমি’। এজন্যই কি ভালো লাগে, নাকি সত্যিই তার কবিতা ভালো লাগে?
আল মাহমুদ : সে কী বলেছিল, তা মনে নেই। কারণ তার দুষ্টুমির কোনো সীমা ছিল না। কোনো কথা নেই বার্তা নেই, ওই আনন্দবাজারের অফিসের নিচে প্যান্টের জিপার খুলে প্রস্রাব করে দিত। এগুলো তো সে করেছে। জীবনটা তো অসহনীয় করে তুলেছিল। আমি বলতে চাই না, কিন্তু আমি অনেক কিছুই জানি। বলা যাবে না, ক্যামেরার সামনে তো নয়ই। সভ্য মানুষ হিসেবে এদের মাঝে মাঝে চিনতে অসুবিধে হয়।

মোহাম্মদ সাদিক : এরকম দু-একটি ঘটনা থাকতেই পারে। মানুষ নানা রকম। এখন যা বলতে চাই, পঞ্চাশের কবিরা কীভাবে তিরিশ থেকে আলাদা হলো? বাইরে আসার পর্বগুলো কী ছিল?
আল মাহমুদ : গোড়ার দিকেই আমরা একটা জিনিস ধরতে পেরেছিলাম যে, আধুনিক সাহিত্য বলতে কবিতাকেই বোঝানো হচ্ছে। আমাদের স্টাডি ছিল—আধুনিক সাহিত্য বলতে আধুনিক গদ্য সাহিত্যকে বুঝতে হবে। বাংলাদেশে এটা অন্যরকম হবে, কারণ ওই সময়ের কয়েকজন কবি কবিতাকে নিয়ে এমনভাবে মেতেছিলেন যে একটা বিভ্রান্তি তৈরি হয়ে গিয়েছিল। তারা বলতেন, কবিতাই আধুনিক সাহিত্যের ভাষা। আমি বিতর্ক করেছিলাম, কিন্তু আমাকে কেউ ছেড়ে কথা বলেনি।

মোহাম্মদ সাদিক : আপনি কিন্তু নিজেও কথাসাহিত্যের চর্চা করেছেন। আপনার কি মনে হয়েছে, আপনি যা বলতে চান, তা শুধু কবিতায় বলে মুক্তি পাচ্ছেন না? এজন্যই কি আপনি কথাসাহিত্য রচনা করেছেন?
আল মাহমুদ : আমি কবি মাত্র। আমি কিন্তু নিজেকে সবসময় কবি হিসেবেই দেখি। আমি অসাধারণ না হলেও অনেক সুন্দর গদ্যও লিখেছি, সেটা বাংলাদেশে অস্বীকৃত হয়নি। তো যাই হোক, আমার মনে হয় যে পঞ্চাশ দশকের কবিরা…
שামীম রেজা : এমন গল্প লেখেননি। আবুল হোসেন আপনার ওপর লিখেছেন। যেহেতু গদ্যের মধ্যেই চলে এলাম, আপনি যে ‘জলবেশ্যা’ গল্পে আবিদের শৈশবের প্রতিমূর্তির কথা বলেছেন—নৌকায় উঠে বেহুলা-লক্ষ্মীন্দরের স্মৃতিচারণ—এটা কি অভিজ্ঞতা নাকি কল্পনার ঢঙে লেখা? এমন কোনো স্মৃতি কি আছে, যা আপনি কবিতায় লিখতে না পেরে গল্পে লিখেছেন?
আল মাহমুদ : আমাদের দেশে সেই সময়ে হাটের দিনে লোকসমাবেশ হতো। সন্ধ্যার পরে নৌকার ওই পাড়ে ছোট ভাসমান গ্রাম থাকত। তারা বাতি জ্বালিয়ে টাকাওয়ালা দালালদের আহ্বান করত। এটাই আমি ওই ‘জলবেশ্যা’য় লিখেছি।
שামীম রেজা : আমি আপনাকে ধরিয়ে দিই—‘কেমন কাবিন মেঘনার পানিৎ লোহার ঢেউয়ের কাবিন নেহি’—এই যে ভাষাটা, এটা তো ব্রাহ্মণবাড়িয়ার ভাষা। আর এই যে ভাসমান বাইদানিদের কথা বলছেন, এরা তো বিভিন্ন জায়গার, নাকি ওখানকার স্থানীয়?
আল মাহমুদ : না।
শামীম রেজা : তাহলে তো ভাষাটা নিয়ে অনেক কথা বলা যায়। যেমন, গর্ভবতীর গান, নারীর স্তনের বর্ণনা—যে বর্ণনা আবিদের মুখ দিয়ে করেছেন, সে ভাষা কি ব্রাহ্মণবাড়িয়ার আঞ্চলিক ভাষা?
আল মাহমুদ : আমার তো মনে নেই।

মোহাম্মদ সাদিক : আপনার ‘পানকৌড়ির রক্ত’ তো খুব আলোচিত গল্প। আপনার বর্তমানে যেসব কবিতায় আবেগ উচ্চারিত হচ্ছে, তা ‘পানকৌড়ির রক্ত’ থেকে অনেক সময় বিচ্ছিন্ন করা যায়। এই তারুণ্যকে আপনি কীভাবে বহন করেছেন?
আল মাহমুদ : ‘পানকৌড়ির রক্ত’-এ বিচিত্র গল্প আছে। আমার ধারণা, আমাদের সাহিত্যে আমিই প্রথম রঙের বিবর্তনে মানুষ কীভাবে প্রভাবিত হয়, সেটা দেখানোর জন্য পানকৌড়ির হত্যাটাকে দেখাতে চেষ্টা করেছি। এটা একজন চিত্রকরের কাজ। যেহেতু আমি কবি, আমি সাধ্যমতো সাজাতে চেষ্টা করেছি। আমার বক্তব্য হলো—এরকম একটি রচনা আমার সমসাময়িক কালের লেখার মধ্যে আর হয়তো নেই।
মোহাম্মদ সাদিক : আপনার এই যে ‘পানকৌড়ির রক্ত’, ‘জলবেশ্যা’—এসব লেখার সাথে পরবর্তীকালের লেখা মিলিয়ে দেখলে এগুলো অনেক উঁচুতে থাকে। এ ধারাকে কেন আপনি এগিয়ে নেননি, নাকি নতুন কিছু করতে চেয়েছেন?
আল মাহমুদ : আমি তো আসলে কবি। তবে আমি যে ভাষায় লিখেছি, এর মধ্যে অনেক কাজ আছে, যা সাধারণ কবি পারে না।
মোহাম্মদ সাদিক : গল্পগুচ্ছ সম্পর্কে কোনো কোনো সমালোচকের একটি অভিযোগ আছে—যদিও আমি এটাকে বড় করে দেখছি না—যে গল্পগুলো একটু গীতিধর্মী। কথাসাহিত্যে যখন কবির প্রভাব বড় হয়ে ওঠে, তখন কথাসাহিত্য কোনোভাবে আহত হয় কি না?
আল মাহমুদ : আমার মনে হয় না।
শামীম রেজা : বরং আরও বেশি সমৃদ্ধ হয়। কবিতা নিয়ে বারবার আপনার সাক্ষাৎকারে, লেখায়, স্মৃতিতে বলেছেন, “আমার কবিতার প্রধান বিষয় নারী এবং প্রকৃতি—এ দুটোই”। আমি যদি জীবনানন্দকে টানি, তাঁর যেমন ‘ঝরা পালক’, ‘ধূসর পাণ্ডুলিপি’, ‘রূপসী বাংলা’—প্রত্যেকটির ধরন আলাদা। আপনার মধ্যে দেখতে পাই, ‘লোক লোকান্তর’ (১৯৬৩), ‘কালের কলস’ (১৯৬৬) এবং ‘সোনালী কাবিন’ (১৯৭৩)—এই তিনটি কাব্যগ্রন্থ একটি ট্রিলজির মতো, যার চূড়ান্ত ফসল ‘সোনালী কাবিন’। এখানে নারী এবং প্রকৃতি সমানভাবে সমন্বিত হয়েছে। কিন্তু একটা অভিযোগ আছে—এখানে শরীরই প্রধান, মনটাকে খুব খুঁজতে হয়। আপনার কী মনে হয়?
আল মাহমুদ : সাহিত্য যত ছদ্মবেশই ধারণ করুক, আমি শরীর খুঁজি।
שামীম রেজা : শরীর না হলে মন কোথায় যাবে?
আল মাহমুদ : এটা অবয়ব। লবণ ছাড়া ডিম খাওয়া যেমন যায় না, সাহিত্যেও শরীরটা প্রধান। শরীরের সাথে কাম আছে, কামের সাথে নানারকম কামজ উপাদান জড়িয়ে আছে। এটা তো আমি বললে হবে না, এটা মানুষের প্রবৃত্তি।

שামীম রেজা : আমি একটু বিস্তারিত করি। ‘লোক লোকান্তর’-এ আমরা যখন দেখি, “আমার চেতনা যেন সাদা এক সত্যিকারের পাখি, বসে আছে সবুজ অরণ্যে এক চন্দনের ডালে।” পরে ‘কালের কলস’-এ রোমান্টিকতার সম্প্রসারণ দেখি। এরপর পূর্ণতা আসে ‘সোনালী কাবিন’-এ: “বধূ বরণের গান গাহিয়াছে মহামাতৃকুল, গাঙের ঢেউয়ের মত কবুল কবুল”। এখানে ঐতিহ্য ও সংস্কৃতি স্পষ্ট। জীবনানন্দে একটা আড়াল আছে। আপনি যখন বলেন, “আমাদের ধর্ম ফসলের সুষম বণ্টন,” তখন কি আপনি কৌম ধর্মের কথা বলছেন? সুফিবাদ মতে, ঈশ্বর বা আল্লাহ মনের মধ্যে থাকে। এই বিশ্বাস আপনার ‘সোনালী কাবিন’-এ পাই, কিন্তু পরবর্তীকালে পাই না।
মোহাম্মদ সাদিক : ‘সোনালী কাবিন’-এ আবহমান বাংলার সামাজিক-সাংস্কৃতিক চেতনার একটি অসাধারণ প্রকাশ পাই। আপনি কি ‘সোনালী কাবিন’-এর চেতনাকে সম্প্রসারিত করার চেষ্টা করেছেন, নাকি সেখান থেকে সরে এসেছেন?
আল মাহমুদ : করেছি, গদ্যে করেছি, পদ্যে করেছি।
মোহাম্মদ সাদিক : আপনি এখনও বিশ্বাস করেন, “আমাদের ধর্ম হোক ফসলের সুষম বণ্টন”?
আল মাহমুদ : কবিতার ভেতরেই কবির বিশ্বাস।

শামীম রেজা : আপনি ‘বখতিয়ারের ঘোড়া’-তে লিখেছেন, “আরব্য রজনী নাজায়েয।” আপনার ‘লোক লোকান্তর’ থেকে ‘সোনালী কাবিন’ পর্যন্ত যে ট্রিলজি, তার পরে ‘বখতিয়ারের ঘোড়া’ থেকে ‘দ্বিতীয় ভাঙ্গন’-এর আগ পর্যন্ত—যেমন ‘দোয়েল ও দয়িতা’, ‘আমি দূরগামী’—এসব কাব্যে ধর্মীয় বোধ আরোপিত মনে হয়। এটাকে আপনি কীভাবে খণ্ডন করবেন?
আল মাহমুদ : এটা কেন আপনার মনে হলো, বোঝা দরকার। আমি কাব্যে রহস্য রাখলেও ঠিকমতো কমিউনিকেট করি। আমি খোলাখুলিই বলেছি।

মোহাম্মদ সাদিক : একাত্তরে আপনি কোথায় ছিলেন?
আল মাহমুদ : আমি কলকাতায় ছিলাম।
মোহাম্মদ সাদিক : কীভাবে কলকাতায় গিয়েছিলেন?
আল মাহমুদ : আমার যতটুকু মনে আছে, দেশে তো থাকতে পারছিলাম না। আমি ট্রেনে করে গৌহাটি হয়ে কলকাতা যাই। আমার ভগ্নিপতি তৌফিক ইমাম আমার বোনজামাই। আমি তাঁর সাথে যাই।
মোহাম্মদ সাদিক : মুক্তিযুদ্ধের সময় তাজউদ্দীন সরকার আপনাকে একটি দায়িত্ব দিয়েছিলেন। কোন দপ্তরের?
আল মাহমুদ : একটা চাকরি দেওয়া হয়েছিল। বাংলাদেশের উত্থানের পক্ষে কথা বলার জন্য মোটিভেশনাল কাজ। মাইনে ছিল ছয়শ টাকার মতো, কিন্তু ত্রাণের জন্য অর্ধেক কেটে রেখে দিত। তিনশ টাকায় চলতাম। কলকাতায় খুব চ্যালেঞ্জিং দিন ছিল। কষ্ট ছিল।
মোহাম্মদ সাদিক : সেই সময়টার কোনো স্মৃতিকথা লেখেননি কেন?
আল মাহমুদ : আমি তো দিনরাত লিখেই যাচ্ছি।
শামীম রেজা : লিখছেন, কিন্তু ওইভাবে তো না। ‘একাত্তরের ডায়রি’ নামে তো লিখতে পারতেন।
আল মাহমুদ : আমি মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছি। আমার যখন মনে পড়ে, আমার সব লেখা মনে হয় আপনারা পড়েননি। আমি কিন্তু বলেছি।

মোহাম্মদ সাদিক : এবার একটু বলবেন কি—প্রাচীনকালের চর্যাপদ থেকে শুরু করে আল মাহমুদ পর্যন্ত কারা কারা বাংলা সাহিত্যে প্রধান কাজ করেছেন?
আল মাহমুদ : প্রথম কথা হলো, সবচেয়ে বড় কাজ যিনি করেছেন তিনি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। রবীন্দ্রনাথ পড়লে বোঝা যায় তিনি কত বড় ছিলেন। তারপরে অবশ্য গুছিয়ে বলতে পারব না। তারপর তিরিশের কবিরা—চোখ ধাঁধিয়ে দেওয়া আধুনিক স্বাদ। তারপর চল্লিশের কবিরা—ফররুখ আহমদ, আহসান হাবীব। দুজনেরই কিন্তু খুব সুন্দর কবিতা আছে।
মোহাম্মদ সাদিক : যাক, আপনি আহসান হাবীবের কথা বলেছেন। আমরা লক্ষ করি, আমাদের কবিরা তাঁদের অনুজ কবিদের সম্পর্কে তেমন কিছু বলতে চান না। কেন তারা অনুজদের সাহিত্য মূল্যায়নে আগ্রহী হন না?
আল মাহমুদ : কথা হলো, এটা ঘটে যায়। কেন যে ঘটে যায়!

মোহাম্মদ সাদিক : আপনি কাজী নজরুল ইসলামের কথা একবারও উচ্চারণ করেননি। এটি কি স্মৃতির কারণে?
আল মাহমুদ : কাজী সাহেবের কথা আমি বলি—একজন অসাধারণ কবিপ্রতিভা। তাঁর ‘বিদ্রোহী’ কবিতার মতো অমন একটি কবিতা বাংলা সাহিত্যে আর নেই। সমস্ত বাংলা সাহিত্যে নেই।
মোহাম্মদ সাদিক : তাঁর প্রেমের কবিতাগুলো?
আল মাহমুদ : তাঁর যে গান আছে, প্রেমের গান—অসাধারণ! গানের ভাষাপদ্ধতি, গানের যে মর্মবাণী, সেটা উনি কিন্তু ক্ল্যাসিকাল থেকে নিয়েছেন।
মোহাম্মদ সাদিক : একটা জিনিস আপনার কবিতায় লক্ষ করি, আপনি চলে যাওয়ার কথা বলেন। কিন্তু আপনার কবিতায় মৃত্যুচেতনা সেভাবে আমাদের চোখে পড়ে না।
আল মাহমুদ : আমি সবচেয়ে বেশি চিন্তা করি মৃত্যুর।
শামীম রেজা : কিন্তু কবিতায় আসে জীবনের কথা, কামের কথা, ভালোবাসার কথা।

মোহাম্মদ সাদিক : আপনি কখনো প্রবলভাবে সামাজিক অঙ্গীকারের কথা বলেছেন, আবার কখনো মনে হয়েছে সাহিত্য তার বাইরের কিছু। এ সম্পর্কে কিছু বলুন।
আল মাহমুদ : আসলে আমি ওই ধারার কবি, যে ভালোবাসা, প্রেম…
মোহাম্মদ সাদিক : ধর্মের বিষয় আপনার লেখায় আসে। সুফি, ফকির, দরবেশদের অবদানকে কীভাবে বিচার করেন?
আল মাহমুদ : আমি ধর্মে বিশ্বাস করি। মওলানা রুমির একটা দল ছিল, তাদের বলা হতো ড্যান্সিং মওলানা, যারা নাচত।
শামীম রেজা : ফানাফিল্লাহ-বাকাবিল্লাহ?
আল মাহমুদ : ওইগুলো আমি কখনো লিখিনি। যদি লিখি, তবে অনেক কথাই লিখতে হবে। আমি লিখব, হোয়েন দ্য টাইম কামস।
মোহাম্মদ সাদিক : ধন্যবাদ মাহমুদ ভাই। আগামী লেখার পরিকল্পনা কী?
আল মাহমুদ : আপাতত, আমার খুঁটিনাটি অনেক কিছু উল্লেখ করে যতটুকু মনে পড়ে, একটা আত্মজীবনী লিখব।
মোহাম্মদ সাদিক : সেটা কি শৈশব থেকে শুরু করবেন?
আল মাহমুদ : না, শৈশব তো লিখে ফেলেছি। ‘যেভাবে বেড়ে উঠি’-তে ঢাকায় এসে শেষ করেছিলাম। ঢাকার জীবনটা ওরকম লেখেননি।
শামীম রেজা : তাহলে ‘যেভাবে বেড়ে উঠি’র পরের অংশ, নাকি একদম শুরু থেকে?
আল মাহমুদ : শুরু থেকেই। পূর্ণাঙ্গ হবে।

মোহাম্মদ সাদিক : কবি শামসুর রাহমান সম্পর্কে জানতে চাই। আপনার বন্ধু এবং আপনার সঙ্গে তাঁর নাম সবসময় উচ্চারিত হয়েছে।
আল মাহমুদ : অনেকে মনে করে, শামসুর রাহমানের সাথে আমার বোধহয় কোনো দ্বন্দ্ব ছিল। এসব কিছুই ছিল না। খুবই ভালো বন্ধু ছিলাম। শামসুর রাহমান চুপচাপ ছিল। আমার বাসায় নীরব একটি জায়গায় চুপচাপ বসত। আমি বলতাম, “কী ব্যাপার?” বলতেন, “আমি বসছি, ভালো লাগছে না।” উনি তো আবার সিগারেট খেতেন না। আমি সিগারেট ধরিয়ে কাছে বসতাম। চোখ বন্ধ করে বসে থাকতেন। কী যেন ভাবতেন। আমার জানা ছিল, শামসুর রাহমানের ভেতরে একটা দ্বন্দ্ব ছিল। এটা হলো তাঁর বিশ্বাসের ব্যাপার।
শামীম রেজা : ধর্মের বিশ্বাস?
আল মাহমুদ : হ্যাঁ, ছিল। এটা তাঁকে খুব কষ্ট দিয়েছে। তিনি আমার বন্ধু ছিলেন।

মোহাম্মদ সাদিক : সাধারণভাবে কবির কাছে সব লেখাই মূল্যবান। আপনার বিচারে আপনার কোন কাব্যগ্রন্থ বা গল্পগ্রন্থ বেশি আদরের?
আল মাহমুদ : ‘সোনালী কাবিন’, নিঃসন্দেহে। ইচ্ছা করলেও আমি ওরকম আর লিখতে পারব না।
শামীম রেজা : বুদ্ধদেব বসুর ‘কবিতা’ পত্রিকায় আপনার কবিতা ছাপা হওয়া আপনার জীবনের শ্রেষ্ঠ স্মরণীয় ঘটনার একটি।
আল মাহমুদ : যখন ‘কবিতা’ পত্রিকা থেকে একটা চিঠি এসেছিল, “তোমার একটি বা দুটি কবিতা ছাপা যাবে মনে হচ্ছে।”
মোহাম্মদ সাদিক : তাতেই আনন্দিত?
আল মাহমুদ : বুদ্ধদেব বসু! ভাবা যায়!
שামীম রেজা : এরকম আর কোনো আনন্দের অনুভূতির কথা বলতে পারেন? কোনো প্রেমিকার সঙ্গে কাটানো মুহূর্তও কি এর চেয়ে বেশি আনন্দের ছিল না?
আল মাহমুদ : না, এ আনন্দ আর কোনো সময় হয়নি।

মোহাম্মদ সাদিক : আপনি যদি কবি না হতেন, তবে কী হতে চাইতেন?
আল মাহমুদ : যদি আমি কবি না হতাম, তবে আমি সংগীতজ্ঞ হতাম।
মোহাম্মদ সাদিক : যদি আপনাকে আপনার গ্রামে ফিরিয়ে দেওয়া হয়, যে বয়সে আপনি গ্রামে ছিলেন, আপনি কাকে খুঁজবেন?
আল মাহমুদ : এটা আমি বলতে চাই না।
মোহাম্মদ সাদিক : ঢাকা শহরে বিউটি বোর্ডিংয়ের আড্ডার সময়ে আপনাকে ফিরিয়ে দেওয়া হলে, আপনি আগে কার ঘরে টোকা দেবেন?
আল মাহমুদ : নামটা নাই-ই বললাম।
שামীম রেজা : আপনার জীবন-অভিজ্ঞতা আমরা আপনার লেখার মধ্যেই পেতে চাই। সেটা কি আপনি সহজ করে লিখবেন?
আল মাহমুদ : আমি চেষ্টা করব।


আরও