শামীম রেজা: জি, ধন্যবাদ। কবি জয় গোস্বামী কলকাতায় ১৯৫৪ সালের ১০ নভেম্বর জন্মগ্রহণ করেন। শৈশব, কৈশোর এবং যৌবনের প্রথম ভাগ কেটেছে রানাঘাটে। সাহিত্য অকাদেমি ও দুবার আনন্দ পুরস্কার-সহ বিভিন্ন পুরস্কার পেয়েছেন কবিতা ও কাব্য-উপন্যাস লিখে। তিনি মনে করেন, কবিতার জগৎ স্বপ্নের জগৎ নয়। কবিতা কবির বিশাল আত্মজীবনী, এক-একটি কবিতা এক-একটি আত্মজীবনীর পৃষ্ঠা। অনিচ্ছায় গৃহবন্দি পৃথিবীর অসুস্থ-অস্থির সময়ে প্রিয় কবি কীভাবে সময় কাটাচ্ছেন?
জয় গোস্বামী: আপনি আমার সম্পর্কে যেসব বিশেষণ প্রয়োগ করলেন, সেগুলো ঠিক যোগ্য নয়। আপনাদের ভালোবাসাই আমাকে এই ধরনের বিশেষণে ভূষিত করেছে। আমি এখন সময় কাটাচ্ছি প্রধানত বই পড়ে আর আমার পরিচিতদের সঙ্গে ফোনে কথাবার্তা বলে। কিন্তু আমি এই সময়ে কিছু লিখতে পারিনি। আমি অনেক দুঃসময় দেখেছি—যেমন জরুরি অবস্থা দেখেছি, নকশাল আন্দোলনের সময় দেখেছি, ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধ দেখেছি। ১৯৭১ সালে বাংলাদেশে যখন পশ্চিম পাকিস্তানের আক্রমণ ঘটল, তখন দলে দলে বহু উদ্বাস্তুর চলে আসা দেখেছি, তাদের দুর্দশা দেখেছি। এই কিছুদিন আগে নন্দীগ্রাম-কাণ্ড দেখেছি। কিন্তু এরকম অভূতপূর্ব অবস্থা আমি আগে কখনো দেখিনি, যখন শত্রুকে দেখা যাচ্ছে না, অথচ তার ভয়ে আমাদের গৃহবন্দি থাকতে হচ্ছে। বাইরের কোনো মানুষ আমাদের বাড়ি আসতে পারছেন না কিংবা আমরাও বেরিয়ে যেতে পারছি না।
শামীম রেজা: হ্যাঁ, এটা ১০০ বছর আগে স্প্যানিশ ফ্লু-এর সময় ঘটেছিল। আপনি তো আমার চেয়ে বয়োজ্যেষ্ঠ, আপনি যেমন বলছেন, এ এক দুর্বিষহ কারাবন্দি অবস্থা, কিন্তু শত্রুকে আমরা দেখতে পাই না। এই যে লিখতে না পারার যন্ত্রণা, এই বোধ… তো এখন কী পড়ছেন? বলছিলেন যে বই পড়ার সুযোগ পাচ্ছেন বা নিজেকে বইয়ের মধ্যে রাখতে পারছেন…
জয় গোস্বামী: বই কিছু কিছু পড়ছি। যেমন, একটা নতুন বই পড়তে শুরু করেছি, সেই বইটার নাম হলো ‘On the Shoulder of Giants’ (2002)। সেটাতে পাঁচজন বিজ্ঞানীর কথা বলা হচ্ছে: কোপার্নিকাস, গ্যালিলিও, কেপলার, আইজ্যাক নিউটন আর আইনস্টাইন। বইটি বলতে চাইছে যে, সেই পাঁচজন দৈত্যের কাঁধে ভর দিয়ে উঠে দাঁড়িয়ে এখনকার অ্যাস্ট্রো-ফিজিক্স, অ্যাস্ট্রোনমি অনেকদূর দেখতে পাচ্ছে। অর্থাৎ, আমরা যদি কোনো দৈত্যাকার ব্যক্তির কাঁধের ওপর উঠে দাঁড়াই, তাহলে তো অনেকটা উঁচু থেকে, অনেক দূর দেখতে পাই। এই বইটা সেই কথাই বলতে চাইছে। এই বইটি যিনি লিখেছেন, তিনিও একজন দৈত্যসদৃশ মানুষ—তাঁর নাম স্টিফেন হকিং। তবে এই বই পড়ার জন্য যে বিদ্যা-বুদ্ধির দরকার, তা তো আমার নেই। সেজন্য আমি আমার বিজ্ঞানী বন্ধুদের ফোন করে যে জায়গাটা বুঝতে পারছি না, সেটা তাঁদের কাছে বুঝে নেওয়ার চেষ্টা করছি। এই-ই…
শামীম রেজা: আচ্ছা, একটু প্রশ্ন-উত্তর পর্বে যেতে চাই, আপনার লেখক হিসেবে বেড়ে ওঠা নিয়ে। আপনার প্রথম বই ‘ক্রিসমাস ও শীতের সনেটগুচ্ছ’ ১৯৭৭ সালের জানুয়ারি মাসে কৃষ্ণনগরের বঙ্গ রত্ন মেশিন প্রেস থেকে ছাপা হয়েছিল। সহযোগিতা করেছিলেন আপনার বন্ধু সুবোধ সরকার এবং ছাপতে খরচ হয়েছিল ১৪৫ টাকা।
জয় গোস্বামী: হ্যাঁ, হ্যাঁ, হ্যাঁ।
শামীম রেজা: টাকাটা আপনার নিজের ছিল, নাকি প্রকাশক দিয়েছিলেন?
জয় গোস্বামী: টাকাটা আমার মা দিয়েছিলেন…
শামীম রেজা: অনেক কৃতজ্ঞতা এবং শ্রদ্ধা জানাচ্ছি মাকে…
জয় গোস্বামী: হ্যাঁ, টাকাটা আমার মা-ই দিয়েছিলেন…
শামীম রেজা: আটটি কবিতা আর বারো পাতার বই। আপনার জীবনের প্রথম কবিতার বইটি কিনেছিলেন সুধীর চৌধুরী। এই নিয়ে আপনার অনুভূতি—সেদিনের আপনি আর আজকের আপনি… রানাঘাট পর্বের স্মৃতি, বিশেষ করে স্বদেশী আন্দোলনের লড়াকু সৈনিক বাবার স্মৃতি থেকে এই প্রথম বই ছাপা পর্যন্ত, যদি একটু বলেন…
জয় গোস্বামী: রানাঘাটের স্মৃতি আমার আজীবন মনে থাকবে, মনে থাকে, আমার লেখায় ঘুরেফিরে আসে। কারণ রানাঘাট আমার কাছে গানে যেমন ‘সা’। ‘সা’ থেকে গান শুরু হয় এবং ফিরে ফিরে ‘সা’ দরকার হয়। তেমনি রানাঘাটও আমার জীবনের ‘সা’-এর মতো। ঘুরেফিরে রানাঘাট, রানাঘাটে কাটানো জীবন আমার মনে পড়ে।
শামীম রেজা: আচ্ছা, আমি পরবর্তী প্রশ্নে চলে যাচ্ছি। বাংলা ভাষার প্রধান কবিদের মধ্যে জীবনানন্দকে দেখি একই সময়ে একদিকে লিখছেন ‘ধূসর পাণ্ডুলিপি’, অন্যদিকে ‘রূপসী বাংলা’। এই পর্বের পরে দেখছি ‘বনলতা সেন’ এবং পরবর্তী সময়ে ‘মহাপৃথিবী’ ও ‘বেলা অবেলা কালবেলা’ লিখছেন, মানে চারটি পর্বে তাঁকে বিভাজন করতে পারছি। আর আপনাকে, বিশেষ করে ‘আলেয়ার হ্রদ’ (১৯৮১), ‘উন্মাদের পাঠক্রম’ (১৯৮৬), ‘ভুতুম ভগবান’ (১৯৮৮)-এর পরপরই পর্ববদল ঘটতে দেখি। ‘ঘুমিয়েছো, ঝাউপাতা?’ (১৯৮৯), ‘পাগলী, তোমার সঙ্গে’ (১৯৯৪)—এইসব কাব্যে আপনি চির রোমান্টিক কবিতায় পৌঁছে যান। প্রথম পর্বে ছিল দারিদ্র্য আর অসুস্থতার সঙ্গে অনিশ্চিত জীবনের লড়াই। দ্বিতীয় পর্বে কর্পোরেট চাকরির অস্থিতিশীলতা। এই যে পর্ব বিভাজন, অর্থাৎ প্রেম পর্বে বা রোমান্টিকতার সময়ে প্রবেশ—এটাকে আপনি কীভাবে নেবেন?
জয় গোস্বামী: আমার জীবনে যখন যা ঘটেছে, তখন তা আমি আমার কবিতার মধ্যে প্রকাশ করার চেষ্টা করেছি। আমি যে চেষ্টা করেছি, তা বলব না; সেটা খানিকটা আপনা-আপনি হয়ে গেছে। আর আমার জীবনে যা ঘটেছে, আমি যে শুধু সেই কথাই লিখেছি তা নয়; আমার আত্মজীবনীর অংশের মধ্যে আমার বন্ধু-বান্ধবদের জীবন, আমার প্রতিবেশীর জীবন, আমার পড়শির জীবন, আমার দেশের জীবন—এই সবই আমার নিজের জীবনের অন্তর্গত হয়ে থেকেছে। এইভাবেই এসব থেকে কবিতা এসেছে আরকি। যখন জীবনে নারী এসেছে, তখন প্রেমের কবিতাও এসেছে এবং যখন নারী চলে গেছে, তখন সেই চলে যাওয়ার বেদনা নিয়েও কবিতা এসেছে। তারপরও অনেক সময় অন্যের জীবনে প্রেমের ঘটনা ঘটতে দেখেছি এবং সেই ঘটনাকে যখন রূপান্তরিত হতে দেখেছি, তখন তা থেকেও লেখা এসেছে। লেখাগুলো খানিকটা আপনা-আপনিই এসেছে বলা যায়।
শামীম রেজা: নারী প্রসঙ্গটা না হয় তোলা থাক। এই পর্বে আমার একটা কথা মনে পড়ছে। আপনার সঙ্গে আমার প্রথম দেখা, আপনার সাক্ষাৎকার নিতে গিয়েছিলাম। প্রথমবার আপনার সাক্ষাৎকার পড়ি বাংলাদেশের ‘মুক্তকণ্ঠ’ পত্রিকার ‘খোলা জানালা’ পাতায়, ২০০১ সালে। যখন কলকাতায় যাই, তখন কবি-বন্ধু বিভাস রায়চৌধুরী আপনার বাসায় নিয়ে গিয়েছিলেন। আমি দৈনিক ‘আজকের কাগজ’-এর ‘সুবর্ণরেখা’ পাতাটি সম্পাদনা করতাম। আপনি সাক্ষাৎকার দিতে রাজি হয়েছিলেন এবং এক ধরনের শ্লেষ বা অন্যরকমভাবে বলেছিলেন যে, “আপনি প্রশ্ন করে উত্তর লিখে নিন।” আমরা তো তখন থেকেই আপনার ভক্ত, তবুও আমার অভিমান হয়েছিল। এই সম্পর্কে বাংলাদেশের দর্শকদের একটু বলুন। কারণ ওই পত্রিকার সাক্ষাৎকারটি সম্পর্কে আপনি আমাকে একটা কথা বলেছিলেন যে, ওই সাক্ষাৎকারটি নেওয়া এবং তার পরবর্তী সময়ে আপনার পক্ষে-বিপক্ষে অনেক চিঠি এসেছিল। সাক্ষাৎকারটি খুব সুন্দরভাবে আপনার অনেক ছবি দিয়ে ছাপা হয়েছিল। বিশ্বাসযোগ্যতার ক্ষেত্রে, আমি দেখেছি, আমি এত বছর যাবৎ শঙ্খদা’র বাড়িতে যাই, আমরা দুই-তিন ঘণ্টা বা সারাদিনও কাটিয়েছি, কিন্তু শঙ্খ ঘোষ খুব বেশি কথা বলেন না। অথচ এখানে দেখি তাঁর সাক্ষাৎকারের বড় বড় বই হয়ে যাচ্ছে। হ্যাঁ, উনি বরিশালের মানুষ, আমাকে খুব প্রীতি করেন, ভালোবাসেন। কিন্তু সাহিত্যের এই না-জানা জায়গাগুলো—যে আপনি বলছেন না, অথচ আমি আপনার সঙ্গে আমার সম্পর্কের খাতিরে সাক্ষাৎকার ছেপে দিচ্ছি! ওই সাক্ষাৎকারটা সম্পর্কে একটু জানতে চাই।
জয় গোস্বামী: প্রথমত বলি, আপনি প্রথমবার যখন আমার বাড়ি গিয়েছিলেন, সেই ঘটনাটি আমার স্মরণে নেই; সে হয়তো আজ থেকে কুড়ি-বাইশ বছর আগেকার কথা হবে। কিন্তু যে ব্যবহার আমি করেছিলাম বলে আপনি বলছেন, সেই ব্যবহারের জন্য আমি এখন দুঃখ প্রকাশ করছি।
শামীম রেজা: না না, আমিও দুঃখ প্রকাশ করছি।
জয় গোস্বামী: আমার মনে হয় না যে, ওই ব্যবহার করে আমি ঠিক কাজ করেছিলাম। আর মানুষ হিসেবে এই কুড়ি বছরে আমি একেবারেই বদলে গিয়েছি, আমি একদম আলাদা রকমের একজন মানুষ হয়ে গিয়েছি। আমার দিন যত পাল্টেছে, বয়স যত বেড়েছে, তত আমি মানুষ হিসেবে পাল্টে গিয়েছি। তার চিহ্ন হয়তো আমার কবিতার মধ্যেও ধরা থাকতে পারে। সুতরাং সেদিক দিয়ে বলতে গেলে, আমার ব্যবহারটা উচিত ব্যবহার হয়নি। আর শঙ্খ ঘোষের ক্ষেত্রে বলব, কলকাতা ‘দেশ পাবলিশিং’ থেকে শঙ্খ ঘোষের একটি বই বেরিয়েছে, বেশ কয়েক বছর আগেই; বইটির নাম ‘কথার পিঠে কথা’। সেই বইটি বেশ মোটা। বইটিতে শঙ্খ ঘোষের দেওয়া বিভিন্ন সাক্ষাৎকার একত্র করা হয়েছে। অর্থাৎ, শঙ্খ ঘোষ যে অনেক সাক্ষাৎকার দিয়েছেন, তার প্রমাণ ওই বইয়ের মধ্যে গ্রন্থিত হয়ে আছে।
শামীম রেজা: জি, জি, বইটা আমার কাছে আছে। আমাদের ওই সাক্ষাৎকারটা সম্পর্কে আপনার কিছু মনে পড়ে?
জয় গোস্বামী: আমার কিছু মনে পড়ে না, জানেন তো। আমি সম্পূর্ণ বিস্মৃত হয়েছি। এখন সম্পূর্ণ বিস্মরণে চলে গেছে ওই দিনটির কথা। আমার মনে পড়ে, আপনাকে আমি প্রথম দেখেছি, আপনি আমার বাড়িতে এসে দেখা করছেন এবং আমি আপনার সঙ্গে কথা বলছি—এটাই আমার প্রথমে মনে পড়ে।
শামীম রেজা: আপনার এক বন্ধু আপনার একটা বিশাল সাক্ষাৎকার ছেপেছিলেন, তারপর ওই সাক্ষাৎকারের বিপক্ষে অনেক লেখা ছাপা হয়েছিল। সেটা সম্পর্কে বলছিলাম…
জয় গোস্বামী: ও… ও, ও! সেই সাক্ষাৎকার কবে বেরিয়েছিল, তা আমার মনে নেই। কোথায় বেরিয়েছিল যেন…
শামীম রেজা: ‘খোলা জানালায়’… আচ্ছা, ঠিক আছে।
জয় গোস্বামী: কোথায় বেরিয়েছিল, তাও আমার ঠিক মনে নেই…
শামীম রেজা: আচ্ছা, ঠিক আছে, ঠিক আছে (হেসে)! ওটা আমাদের বাংলাদেশের একটা পত্রিকার সাক্ষাৎকার ছিল, আপনার অনেক ছবি-টবি দিয়ে ছাপা হয়েছিল।
জয় গোস্বামী: মানুষ যখন লেখে—কবিতা, গল্প বা উপন্যাস—তখন তার পক্ষে-বিপক্ষে নানা রকম মত আসবেই। এটা মেনে নিতেই হবে। এটা জেনেই লিখতে হবে যে, আমি যখন কিছু লিখছি, তখন আমার বিপক্ষে বা আমার লেখার ত্রুটি নিশ্চয়ই কারও চোখে পড়বে। আমার লেখার যে ভুল বা অন্যায্যতা, তা নিশ্চয়ই কারও না কারও চোখে পড়বেই এবং তিনি সেটা বলবেন। এটা মেনে নিয়েই লেখার চেষ্টা করতে হবে। এটাই আমার ধারণা।
শামীম রেজা: হ্যাঁ, সেটাই।
জয় গোস্বামী: কারণ আমি যা লিখব, তাই-ই যে সম্পূর্ণ নির্ভুল বা ত্রুটিমুক্ত হবে, এমন আত্মবিশ্বাস আমার নেই। আমি যা লিখব, তার মধ্যে কিছু ত্রুটি থাকবেই। সেই ত্রুটি যদি কেউ দেখিয়ে দেন, তাহলে তিনি আমার বিপক্ষে বললেন, কিন্তু বিপক্ষে বললেও তিনি একদিক দিয়ে আমার উপকারই করলেন। কারণ তিনি আমাকে দেখিয়ে দিলেন আমার কোন জায়গায় খামতি আছে, কোথায় ক্ষতি আছে। আমার ক্ষতির দিকটা তিনি দেখিয়ে দিলেন। ফলে তিনিও আমার উপকারীই করলেন। আমি এখন জিনিসটা এইভাবে দেখি।
শামীম রেজা: আপনি তো ব্যাপারটা খুব ইতিবাচকভাবে দেখেছেন। কিন্তু আপনি যে কথাটি বলেনইনি, ধরুন যে সাক্ষাৎকার দেননি, সেটা যদি আমি ছেপে দিই, সেটাও কি আপনি মেনে নেবেন?
জয় গোস্বামী: না, তা মেনে নেব না।
শামীম রেজা: (হাসি) সেটা নিয়েই কথা হচ্ছিল! আচ্ছা, আমরা সেই আগের প্রেম পর্বের কথায় ফিরি। ‘ব্যক্তিগত আলাপচারিতায়’ আপনি বলেছিলেন উদ্দীপ্ত যৌবনের কথা—ভালো কবিতা যৌবনে হয়। আপনি মধ্য-যৌবনে ক্ষমতার কেন্দ্রে ছিলেন, বিশেষ করে বাংলা ভাষার অন্যতম কাগজ ‘দেশ’ পত্রিকার কবিতা সম্পাদনা করতেন। যৌবন ও ক্ষমতা, দুটি ছাড়ার পরের লেখা, অর্থাৎ এখনকার লেখালেখি সম্পর্কে যদি একটু বলেন? আবার এই পর্বে পাঠক সংযোগ রক্ষা করতে গিয়েই কি প্রেমের কবিতা রচনা এক ধরনের নিয়তি হয়ে গিয়েছিল? এই সম্পর্কে বিস্তারিত বলবেন?
জয় গোস্বামী: ওটা পাঠক সংযোগ রক্ষা করতে গিয়ে হয়নি। ওটা আমার জীবনের মধ্যেই ঘটেছে। আমার এই জীবনে একাধিক নারীর আগমন ঘটেছে। আমার যে একটি নারীর সঙ্গেই জীবনে বন্ধুত্ব হয়েছে, তা নয়। আমার জীবনে একাধিক নারীর সঙ্গে বন্ধুত্ব হয়েছে; অনেকেই এসেছেন এবং চলে গেছেন। “আমারে যে ডাক দেবে এ জীবনে তারে বারংবার ফিরেছি ডাকিয়া”। …সেই আরকি! “সে নারী বিচিত্র বেশে মৃদু হেসে খুলিয়াছে দ্বার”… সেই আরকি! তো এই ঘটনা সবার জীবনে যেমন সত্য, আমার জীবনেও তেমন সত্য হয়েছে।
শামীম রেজা: এমন কোনো প্রেমের ক্ষতের কথা মনে পড়ে, যা এখনও প্রতিনিয়ত আপনাকে যন্ত্রণা দেয়?
জয় গোস্বামী: এগুলো কবিতার মধ্যে, গল্প-উপন্যাসের মধ্যে চলে এসেছে।
শামীম রেজা: তৃতীয় পর্বে আপনার কবিতায় যে বৈপ্লবিক পরিবর্তন পাই—যেমন এর আগে আমরা বলছি, হয়তো মূলধারা বা ধ্রুপদী ধারা, ‘উন্মাদের পাঠক্রমে’ কাব্যগ্রন্থের সেই সৎকার-গাথা, সেই মায়াবী পাঠ, পরাবাস্তব বা ম্যাজিক্যাল চিত্রকল্প—সেগুলো আর নেই। এমনকি ‘ঘুমিয়েছো, ঝাউপাতা?’ কাব্যগ্রন্থের ওই যে কুমারের দুই বুকে ভাওয়াইয়া-ভাটিয়ালি, সেগুলোও নেই। এখানে সরাসরি শাসকের প্রতি কাব্যগ্রন্থ। আমরা দেখতে পাই শেষ কবিতায়—
“যখনই প্রেমের কথা লিখব বলে কলম খুলছি,
নিহতের দেহ এসে, আমার খাতায় শুয়ে পড়ে,
খাতার প্রান্তরে তাকে মাঝখান দিয়ে কেটে খাল বয়ে যায়,
জোছনায় দাঁড়িয়ে থাকে লাশ গুম করার সাইকেল-ভ্যান,
জোছনায় দাঁড়িয়ে থাকে মাথায় চাদর মোড়া ভ্যানের চালক…”
সরাসরি এই কবিতায় শিল্পগুণ কি নষ্ট হয়েছে?
জয় গোস্বামী: আসলে, আমি যেটা আপনাকে বললাম, আমার জীবনে আমি যা ঘটতে দেখেছি, সে জীবন যে শুধু আমার ব্যক্তিগত জীবন—অর্থাৎ আমার স্ত্রী-কন্যা, আমার ঘরটুকু নিয়ে—তা নয়। আমার ব্যক্তিগত জীবনের মধ্যে আমার দেশের জীবন আছে, আমার সমকালের জীবনও আছে, আমার বন্ধুদের জীবনও আছে। ২০০৭ সালে নন্দীগ্রাম বলে একটি গ্রামে পুলিশ গুলি চালায় এবং তৎকালীন শাসক দলের ক্যাডাররা চটি পায়ে, অর্থাৎ পুলিশের পোশাক ছাড়া, নেমে গিয়ে গুলি চালায় এবং ধর্ষণ করে। এই ঘটনায় সারা পশ্চিমবঙ্গ খুব ক্ষুব্ধ হয়ে ওঠে। আমি তখন এই শাসকের প্রতি এই বইটি রচনা করেছিলাম।
শামীম রেজা: আপনি এক জায়গায় বর্ণনা করেছিলেন, আপনি কীভাবে ব্রাত্য বসুর সঙ্গে গিয়ে মানুষের সেই আহাজারি দেখেছেন—
জয় গোস্বামী: ব্রাত্য বসু ছিলেন, অপর্ণা সেন ছিলেন, অর্পিতা ঘোষ ছিলেন, শুভাপ্রসন্ন ছিলেন, যোগেন চৌধুরী ছিলেন—এরা সকলেই ছিলেন। আমরা গিয়েছিলাম নেতাই গ্রামে। আমরা নন্দীগ্রামে গিয়েছি আর গিয়ে দেখেছি ওই গণহত্যা। নেতাই গ্রামে যে গণহত্যা হলো, যার ওপর আমি ‘হার্মাদ শিবির’ বলে আমার বই লিখলাম, সেই নেতাই গ্রামে কংসাবতী নদীর তীরে রয়েছে পরপর সাতটা চিতা শোয়ানো। পোড়া কালো কালো ছাই পড়ে আছে, নদীর এপার থেকে দেখা যাচ্ছে। আমরা গিয়ে দেখলাম, দেওয়ালে গুলির দাগ। ‘সরস্বতী ঘোড়াই’ বলে একজন মহিলার মাথায় গুলি লেগেছিল। সেই গুলি ছিটকে গিয়ে যখন দেওয়ালে লাগে, তখন তাঁর মাথার লম্বা চুল দেওয়ালের সঙ্গে আটকে ছিল। আমি দেখেছি, সেই চুল হাওয়ায় উড়ছে আর তার পাশে একটা ফড়িং ঘুরে বেড়াচ্ছে। এই দৃশ্য দেখে এসে এবং যখন শুভাপ্রসন্ন বা অন্যরা গ্রামবাসীদের বলছেন যে, “আপনারা বলুন আপনাদের উপর কী ঘটেছে,” তখন এক বিধবা মহিলা তাঁর ন্যাড়ামাথা ছেলের হাত ধরে বলছেন, “তুই কিছু বলবি না, আমরা কিছু বলব না। আমার স্বামী ছিল, আমার বড় ছেলে ছিল। আমার স্বামী গেছে, আমার বড় ছেলেও গেছে সেদিনকার গুলিচালনায়। এখন শুধু এই এক ছেলেই আছে। এখন যদি আমরা মুখ খুলি বা কোনো কথা বলি, তাহলে এও থাকবে না। আমি একে হারাতে পারব না।” এই জিনিস দেখে আমি যখন ট্রাকে করে ফিরে আসছি, তখন আমার মাথায় ঝড়ের মতো কবিতার লাইন আসতে থাকে। আপনাকে একটা কথা বলা দরকার, আমি কবিতায় মাঝেমধ্যে বিরতি স্বীকার করেছি। কখনো কখনো আমি লিখিনি। যেমন এই ঘটনাটা ঘটবার আগে, নেতাই গ্রামের গণহত্যার আগে, তিন বছর—আমার ৫৩ বছর বয়স থেকে ৫৬ বছর বয়স পর্যন্ত আমি কোনো কবিতা লিখিনি। আসলে ঠিক বলতে গেলে, দু-বছর এগারো মাস আমি কোনো কবিতা লিখিনি। আমি অপেক্ষা করেছিলাম যে কবিতা আসবে; কবিতা না এলে আমি লিখতে পারি না। নিজে চেষ্টা করে লিখব, সেটা আমি পারি না; কবিতা আসবে! আমি সেই সময়টা ‘গোঁসাইবাগান’ লিখছিলাম, ফলে আমি কবিতার সঙ্গে যুক্ত ছিলাম। আমি যে কবিতা নিজে লিখছি না বলে কবিতার সঙ্গে আমার যোগ নেই, তা নয়। আমি অন্যদের কবিতা পড়ছিলাম এবং অন্যদের কবিতা সম্পর্কে লিখছিলাম। আমি আমার কবিতা রচনায় মাঝেমধ্যে বিরতি স্বীকার করেছি।
[আর্কাইভ থেকে]