শুক্রবার , ১০ই অক্টোবর, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ

প্রবন্ধ

দেশভাগের কারণে বাংলা সাহিত্যের অপূরণীয় ক্ষতি

বাংলা ভাষা ও সাহিত্য হাজার বছরের ঐতিহ্য বহন করে চলেছে। এই সাহিত্য যেমন বাউলদের দরদি কণ্ঠে প্রাণ পেয়েছে, তেমনি বিদ্যাসাগর, রবীন্দ্রনাথ, নজরুল, জীবনানন্দ, বিভূতিভূষণের হাতে পেয়েছে জ্ঞান, মনন ও নান্দনিকতার স্বরূপ। কিন্তু ১৯৪৭ সালে উপমহাদেশে ঘটে যাওয়া দেশভাগ এই ধারাবাহিক সাহিত্যচর্চার ওপর এক গভীর ও মর্মান্তিক আঘাত হানে। ভারত-পাকিস্তান বিভক্তির ফলে বাংলা ভাষাভাষী জনগণ দুটি আলাদা রাষ্ট্রে পরিণত হয় পূর্ববঙ্গে (পাকিস্তানের অংশ, পরে বাংলাদেশ) এবং পশ্চিমবঙ্গে (ভারতের অংশ)। এই রাজনৈতিক বিভাজন বাংলা সাহিত্যে সৃষ্টি করে সাংস্কৃতিক বিচ্ছিন্নতা, মননের ব্যাঘাত এবং যোগাযোগের ছেদ, যার ক্ষত আজও পূরণ হয়নি।

দেশভাগ শুধু একটি রাজনৈতিক ঘটনা ছিল না, এটি ছিল এক ভয়াবহ মানবিক বিপর্যয়। লক্ষ লক্ষ মানুষ শিকড় ছেড়ে উদ্বাস্তু হয়ে পড়ে। কেউ পূর্ববঙ্গ থেকে পশ্চিমে, কেউ পশ্চিমবঙ্গ থেকে পূর্বে চলে আসে। সম্প্রীতির বাতাবরণে যে সাহিত্যিক পরিবেশে গড়ে উঠেছিল এক অভিন্ন বাংলা সাহিত্যচর্চা, তা মুহূর্তেই ভেঙে পড়ে। বহু প্রতিভাধর লেখক পূর্ববঙ্গ ছেড়ে কলকাতায় চলে যান; যেমন সমরেশ বসু, সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায়, অন্নদাশঙ্কর রায় প্রমুখ। অপরদিকে, পূর্ববঙ্গে থেকে যাওয়া লেখকরা একপ্রকার সাংস্কৃতিক নিঃসঙ্গতায় ভুগতে থাকেন। কলকাতা ছিল বাংলা সাহিত্যের প্রধান কেন্দ্র, যার সমস্ত প্রকাশনা, পত্রিকা, সাহিত্য সভা, বিতর্ক ও আলোচনার কেন্দ্রবিন্দু ছিল। পূর্ববঙ্গে এতটা সংগঠিত পরিকাঠামো গড়ে ওঠেনি। ফলে বিভাজনের ফলে দুই বাংলার সাহিত্যিক যোগাযোগ প্রায় সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়।

এছাড়া প্রকাশনা জগতেও দেশভাগের এক সুস্পষ্ট প্রভাব পড়ে। কলকাতার প্রকাশকরা পূর্ববঙ্গের লেখকদের লেখা প্রকাশে আগ্রহ হারিয়ে ফেলেন। আবার, পূর্ববঙ্গের লেখকরাও কলকাতার বাজারে প্রবেশ করতে না পেরে স্থানীয়ভাবে নিজেদের প্রচার ও পাঠক গড়ে তুলতে ব্যর্থ হন। এমনকি অনেক ভালো মানের সাহিত্যও স্থানাভাবে বা পরিচিতির অভাবে বিস্মৃতির অতলে তলিয়ে যায়। বহু উদীয়মান প্রতিভা হারিয়ে যায় এই সামাজিক ও সাংস্কৃতিক অস্থিরতার মধ্যে।

তবে সাহিত্যের ক্ষেত্রে সবচেয়ে দুঃখজনক ক্ষতি ঘটে মানসিক ও বিষয়গত দিক থেকে। দেশভাগের পরে বাংলা সাহিত্যে এক নতুন ধারা সূচিত হয় যেখানে ঘরছাড়া, উদ্বাস্তু জীবন, আত্মপরিচয়ের সংকট, সহিংসতা ও বিভীষিকার গল্প প্রধান হয়ে ওঠে। এইসব সাহিত্য কর্মগুলো অবশ্য মূল্যবান, কারণ এগুলো দেশভাগের গভীর ক্ষত ও সত্যকে উন্মোচন করে। জীবনানন্দ দাশ তাঁর কবিতায় বারবার উঠে এনেছেন একাকীত্ব ও নৈরাশ্যের চিত্র। মহাশ্বেতা দেবীর ‘রুদ্রসন্ধ্যা’ বা ‘ত্রুটি’ গল্পে দেশভাগ-পরবর্তী বাস্তবতার নির্মম প্রতিফলন দেখা যায়। সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ, হাসান আজিজুল হক কিংবা শওকত ওসমান তাঁদের লেখায় দেশভাগের ফলে মানুষের মনোজগতের জটিলতা তুলে ধরেছেন। কিন্তু এই সাহিত্যিক অর্জনগুলি সত্ত্বেও, দেশভাগের জন্য বাংলা সাহিত্য এক দীর্ঘকালীন সাংস্কৃতিক সংহতির সম্ভাবনা হারায়।

আরেকটি বড় ক্ষতি হয় ভাষার দিক থেকে। দেশভাগের পরে পূর্ববঙ্গে (পাকিস্তান) উর্দুকে রাষ্ট্রভাষা করার চাপ আসলে ভাষা আন্দোলনের সূচনা হয়। যদিও ভাষা আন্দোলন পরবর্তীকালে এক নতুন সাহিত্যিক চেতনার জন্ম দেয়, শুরুতে এটি বাংলা সাহিত্যের স্বাভাবিক প্রবাহে বাধা তৈরি করে। সাহিত্য শুধু ভাষার বিষয় নয়, তা পরিবেশ, পরস্পরের আদান-প্রদানের ওপর নির্ভর করে। দেশভাগ সেই আদান-প্রদানে ছেদ টেনে দেয়।

অবশেষে বলা যায়, দেশভাগ বাংলা সাহিত্যকে এমন এক বিভক্ত চেতনার মুখোমুখি করে দেয়, যা পূর্বে ছিল না। দুই বাংলার সাহিত্য দুই ভিন্ন রাজনৈতিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক বাস্তবতার মধ্যে আলাদা হয়ে যায়। এই বিভাজনের ফলে বাংলা সাহিত্য যেমন একটি সামগ্রিক সত্তা হিসেবে এগিয়ে যেতে পারেনি, তেমনি হারিয়েছে বহু সম্ভাবনাময় প্রতিভা, সাহিত্যিক সংলাপ এবং ঐক্যবদ্ধ সাহিত্যচর্চার ঐতিহ্য। এই ক্ষত কেবল সংখ্যায় নয়, মানসিক, সাংস্কৃতিক এবং ঐতিহাসিক অর্থেও অপরিণীয় যার দাগ এখনও বাংলা সাহিত্যের শরীরে বয়ে চলছে।


আরও